চন্দ্রকারিগর । লুতফুন নাহার লতা

চোখের পলকে সময় চলে যায়, কতগুলো বছর হয়ে গেল তিনি নেই। আকাশের অনন্ত নক্ষত্রবীথি থেকে ঝরে গেলেন বড় প্রিয় মানুষটি। লেখক, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গল্পকার, গীতিকার, চিত্রকর পরিচালক আর বৃক্ষপ্রেমীএকজন মানুষ। আমার প্রথম সিরিজ নাটকের জনপ্রিয় নাট্যকার এক অলৌকিক কারিগর হুমায়ূন আহমেদ।
তাঁর নাটকে কাজ করার অনেক স্মৃতি। সেসব স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে। সেবার ছেলেকে নিয়ে ইউরোপ ঘুরব বলে বেরিয়েছিলাম। লন্ডন জার্মানী হয়ে নরওয়েতে গেলাম, সেখান থেকে দিন তিনেক পরে রওনা হলাম লন্ডনের পথে। বন্ধু সালাম ভাই ভাবীর বাসা থেকে বেরুবো এমন সময় টিভি তে শোনা গেল হুমায়ূন আহমেদের অবস্থা খুব খারাপ। লেখক প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম মিডিয়াকে জানাচ্ছে পরিস্থিতি ভালর দিকে। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে বেরিয়েছি। জানি লন্ডনে পৌঁছেই খবর পাবো।
ঘন্টা দুই তিনেকের মধ্যে লন্ডনে পৌছে খবর পেলাম তিনি এরই মধ্যে চলে গেছেন। জুলাইয়ের নয় বা দশ হবে। আমি নিউইয়র্ক থেকে বেরিয়ে পড়ার আগে একদিন গেলাম বেলভিউ হসপিটালে তাঁকে দেখতে, কিন্তু তিনি যেখানে আছেন সেখানে সবাইকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে তাকে এক নজর দেখার জোর চেষ্টা করলাম। দেখা হল না। ততোক্ষণে আঁধার নেমেছে ম্যানহ্যাটানের রাস্তায়। নিয়নের আলোয় ধীর পায়ে একাএকা ঘরে ফিরছি হঠাৎ মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে 'মিস মিলি!' আমি চারিদিকে চেয়ে কাউকে দেখলাম না। বেলভিউ হাসপাতাল থেকে এফ ট্রেনের সাবওয়ে স্টেশান বেশ দূর। এই পথ ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরে যাচ্ছি। মন বলছে আর দেখা হবেনা এ জীবনে।
শেষ দেখা হয়েছিল জামাইকায় তার বাসায়। সেদিন বাসন্তি পূজো। পরেছি বাসন্তি রঙের শাড়ী। হলুদ গাঁদা ফুলে সাজিয়েছি খোঁপা। পূজোর অনুষ্ঠানে মঞ্চের উপরে আমি। আমার একক পরিবেশনা চলছে। আগেই কথা ছিল অনুষ্ঠান। শেষে মুনিয়াদের সাথে একসাথে যাব হুমায়ুন ভাইকে দেখতে। রাত তখন বেশ হয়েছে। বাইরে কেমন উদাস হাওয়া বইছে সেদিন। কেবল মনে হচ্ছে কেমন দেখব হুমায়ুন ভাইকে। বাসায় গিয়ে দেখি, বসার ঘরে নিষাদ কেঁদে চলেছে কারন ছোট ভাই নিনিত তাকে ধাক্কা মেরেছে। নিনিত দূরে দাঁড়িয়ে অভিনয় করে দেখাচ্ছে সে কেমন করে ভাইকে মেরেছে। লজ্জা পেয়ে নিষাদ মার কোল থেকে নেমে দৌড়ে গেল বাবার কাছে। ভারী ক্লান্ত শাওন। কত কত রাত সে ভালো করে ঘুমায়নি। ওর মুখের দিকে চেয়ে মন খারাপ হল। দিনের পরে দিন ওই মেয়েটির উপর দিয়ে বয়ে চলেছে এক অকালবৈশাখী।
হুমায়ুন ভাই শোবার ঘরে। সম্ভবত দেশে কারো সাথে কথা বলছেন। আমি এসেছি সে খবর পেয়েছেন কিনা বোঝা গেল না। কিছুক্ষন পরে এক হাতে নিষাদকে পেটের উপর বেঁধে নিয়ে অন্যহাতে লুঙ্গির গিট ধরে, খালিগায়ে, খালিপায়ে এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই এক রকম জোরেই হেসে উঠলাম। সারা মাথা, মুখ, বুক, পেট বেয়ে নামছে দুধের ধারা। সব সাদা। বাবার সাথে বনিবনা না হওয়ায় ছোট্ট নিনিত দুধের বোতল ছুড়ে মেরেছে আর তা খুলে গিয়ে বাবার মাথায় পড়ে এই অবস্থা।
আমরা সবাই মিলে তাকে মুছানোর চেস্টা করলাম। উনি এক মুখ হাসি ছড়িয়ে আমার দিকে সরাসরি চেয়ে বললেন 'মিস মিলি আপনার কি কোনোদিন বয়স বাড়বে না!' সাথে সাথে সমস্ত আকাশ উঠলো হেসে, পুরো পরিবেশ গেলো বদলে। কোথায় ভেবেছিলাম হুমায়ূন ভাইকে দেখে কেমন করে কান্না লুকিয়ে হেসে হেসে কথা বলব। মনে মনে তার একটা রিহার্সাল মত ভেবেও রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম হুমায়ূন ভাইকে বলব 'এই সব দিনরাত্রির বাবলু'র কথা। তার সেই বিখ্যাত ডায়লগ 'হৈয়ার বাড়ি গেছিলাম দুধ ভাত দিছিল দুধভাত খাইছিলাম!' সেই কথা। বাবলু এই শহরেই থাকে, অনেক বড় হয়ে গেছে ---এইসব।
নাহ সে কথা বলার আর অবকাশ রইল না। আমিও হেসে বললাম হ্যা হুমায়ুন ভাই সেই যে আপনি আমাকে মিস মিলি বানিয়েছিলেন বয়স ওখানেই আটকে আছে। রাত বেড়েছে আরো। ঘরে ফেরার পালা। বের হয়ে আসার আগে দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়ালেন আমাদের পিছু পিছু-----
আমার মনে পড়ল ১৯৮৮ তে আমরা যখন বহুব্রীহি নাটকের কাজ করছি তখন টেলিভিশনে রাজাকার শব্দটি বলা যেত না। কিন্তু কি অসম দৃঢ়তায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের কালা কানুন ভেঙ্গে পাখীকে চরিত্র বানিয়ে সেই পাখীর মুখ দিয়ে রাজাকার আলবদর পাকিস্তানের দোসরদের বিরুদ্ধে সারা জীবনের ঘৃনা ও ধিক্কার জানিয়ে দিলেন। বাংলার মানুষ আবার দীর্ঘকাল পরে জ্বলে উঠল ঘৃনায়। ফিরে যেতে যেতে চোখ বেয়ে আমার জলের ধারা নামল। বিপন্ন বাসনা তবু তাঁর মঙ্গল কামনায় নতজানু হল। আমি যেনো সারা আকাশ জুড়ে থৈ থৈ পূর্ণিমার ধু ধু জোতস্নায় হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টিয়ার মুখে সমস্বরে সেই ধিক্কারের স্লোগান শুনতে পেলাম। তুই রাজাকার! তুই রাজাকার! তুই রাজাকার !!!
লন্ডনে মহা সমারোহে চলছে অলিম্পিকের আয়োজন। সারা পৃথিবী থেকে ক্রীড়ামোদীরা এসে ভরে গেছে এই শহর। তিল ধারনের ঠাই নেই এমন অবস্থা। ২০ সে জুলাই সারাদিন কেটে গেল বাকিংহাম প্যালেসের সামনে, লন্ডনের ট্রাফেলগার স্কোয়ার, লন্ডন টাওয়ার আর লন্ডন ব্রীজের আশেপাশে হুমায়ূন ভাই নেই সেই সংবাদের ভার বুকে নিয়ে । এবারের ইউরোপ যাত্রায় আমার ছেলে সিদ্ধার্থ আমার সঙ্গী। তার লিস্ট অনুসারে অনেক কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলেও মায়ের মন খারাপের কারনে এবার তা দেখা হল না বলে তার মন একটু খারাপ হল।
কথা ছিল ফ্রাংকফুর্ট, বার্লিন হয়ে লন্ডনে এসে কয়েকটি দিন থাকব আর সে সব ঘুরে ঘুরে দেখবে। কিন্তু এর মধ্যে থেকে তিন, চার দিনের জন্যে আবার নরওয়েতে যাবার প্লান করায় সে টা আর হল না। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল পিকাডিলি সার্কাসে একটি সন্ধ্যা কাটানোর। লন্ডনে এলে সব সময় আমার প্রিয় হ্যারডস থেকে এক চক্কর না ঘুরে আসলে আমার মনেই হয় না, লন্ডনে এলাম। মনের অতৃপ্তি মনে রেখে আর আমার দিকে কপাল কুচকে চোখ সরু করে তাকিয়ে পরদিন হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে সে ফিরে গেল নিউইয়র্ক আর আমি চললাম বাংলাদেশে।
সারাটি পথ মনে পড়লো কত কথা। কত বছর নাটক করিনি অথচ চোখ বন্ধ করলেই আমার চোখের সামনে আজো বাংলাদেশ টেলিভিশনের তিন নাম্বার স্টুডিওর ক্যামেরা গুলোর লালবাতি জ্বলে ওঠে। সেখানে আমি কেবল এইসব দিনরাত্রির সেট দেখতে পাই।
১৯৯৭ সালে বুক ভরা অভিমান নিয়ে স্বদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। ১৯৯৬ তে নিজের জীবন বাজী রেখে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষার জন্য প্রতিবাদের দূর্গ গড়ে তুলেছিলাম। আমার অহংকার আমি নেমেছিলাম রাজপথে। আমার গৌরব আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার প্রাপ্তি, সেই ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আজো এই দেশের মাটিতে নিশ্বাস ফেলতে পারছেন। ওরা বেঁচে আছেন কিন্তু আমি দেশের কাছে, সরকারের কাছে রইলাম মুল্যায়নহীন, বহুদূরের একজন অচেনা মানুষ। যে দেশ ও তার মানুষের জন্য আমার কতনা হাহাকার সেই প্রিয় স্বদেশের সীমানা ছেড়ে, দেশান্তরী হয়েছিলাম আমার পাঁচ বছরের একমাত্র সন্তান সিদ্ধার্থকে নিয়ে। পেছনে ফেলে গেলাম আমার জননী, জন্মভূমি। আমার কর্মক্ষেত্র সর্বত্র। রেডিও, আমার টেলিভিশন , আমার মঞ্চ ,আর আমার স্বত্বার শেকড়, আমার নাটক !!!
২২ জুলাই রোববার সকালে প্লেনের জানালা দিয়ে লাল রঙের মাটি দেখা গেলে আমার আত্মা বরাবরের মত হু হু করে কেঁদে উঠল। ঐ তো, ঐ তো আমার দেশের মাটি। আমার দেশ। প্লেন রানওয়ে স্পর্শ করল, আমি লন্ডন থেকে ঢাকায় পৌঁছুলাম। এয়ারপোর্টের ঝামেলা শেষ করে বের হবার সময় একজন অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম 'আজ তো নিউইয়র্ক থেকে লেখক হুমায়ূন আহমেদের আসার কথা, উনি কি এসেছেন?' জবাবে উনি যা বললেন, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে সেজন্য আজ নয়,উনি কাল সকালে এসে পৌঁছবেন।
দেশে যখনি যাই প্রতিবারের মত এবারেও এয়ারপোর্টে বিশেষ সম্মান, বিশেষ যত্নের এতোটুকু ত্রুটি হল না। আমাকে বসিয়ে আমার নাটকের কথা বলতে কেউ ভুললেন না। এবারে তার সাথে যুক্ত হল আমার অধিকাংশ নাটকের প্রিয় নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদের নাম। কেমন করে তারা অধীর অপেক্ষায় বসে থাকতেন আমাদের নাটকের জন্য, হুমায়ুন আহমেদের প্রথম টেলিভিশন সিরিজ নাটক 'এইসব দিনরাত্রি ' প্রচারিত হত মঙ্গলবারে। সেদিন সন্ধ্যার পরেই ঢাকা শহর নিরব শুন শান হয়ে যেতো। সবাই নাটক দেখবে বলে ঘরে ফিরে আসত তাড়াতাড়ি। এমন অনেক কথার ফাঁকে ফাঁকে সবাই ছল ছল চোখে হুমায়ুন আহমেদের আত্মার শান্তি কামনা করলেন। একটি ছোট্ট জীবনে এতো মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছে এ এক অপার বিস্ময়। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এলাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সাদা শাড়ী পরে রেডি হলাম শহিদ মিনারে যাবার জন্য প্রতি বছর এই সময়টাতে আমি দেশে আসি।আর সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানিনা শহিদ মিনারে ছুটে যেতে হয় কারো না কারো জন্যে বিদায়ের এই মহাসমারোহে। গত বছর এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম অনন্যসাধারন দুই সংস্কৃতি কর্মী, ফিল্ম মেকার তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনিরের অকাল প্রয়ানে। আজ প্রিয় হুমায়ূন ভাইয়ের জন্যে।
বহুদূর থেকে হুমায়ূন ভাই এসেছেন আজ সকালে। সারা বাংলাদেশ ভেঙ্গে পড়েছে শহিদ মিনারে। লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকার, নাট্য ব্যাক্তিত্ব, অভিনেতা অভিনেত্রী, ছাত্র, শিক্ষক, সকল সাংস্কৃতিক সংগঠন, সকল মিডিয়া আর হাজার হাজার মানুষ এসেছে স্রোতের মত সারা বাংলাদেশ থেকে। লোকে লোকারন্য। সকল টিভি চ্যানেল গুলো এসে তাদের অবস্থান নিয়েছে অনেক আগেই। ক্রেনের মত লম্বা স্কাই স্ক্র্যাপারের সাহায্যে ক্যামেরাম্যান উপর থেকে ক্যামেরা প্যান করে স্ক্রল আপ বা স্ক্রল ডাউন করে ছবি নিচ্ছেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক কর্মী কেউ কেউ ধারাবর্ননা দিচ্ছেন।
সব কটি টিভি চ্যানেল সরাসরি সমপ্রচার করছে এই বিদায় উৎসব। হ্যাঁ উৎসবই তো। মানুষের স্রোত চলেছে সারি দিয়ে। প্রিয় লেখক, প্রিয় নাট্যকার, প্রিয় পরিচালক, প্রিয় মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে শেষ বারের মত দেখতে। তাদের হৃদয় নিংড়ান শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে। হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ফুল কদম, যত দূর চোখ যায় প্রায় সবার হাতে কদম। সেই সাথে বকুল, জুঁই, বেলী, দোলনচাঁপা সহ নানা রকম সাদা ফুলে ওদের দুহাত ভরা। জীবনে তিনি যেমন উজাড় করে দিয়ে গেছেন তার পাঠক, দর্শক, শ্রোতাদের তেমনি আজ ওরাও প্রান উজাড় করে এনেছে ওদের পরম ভালোবাসা একজন হিমু'র জন্যে।
ওনাকে রাখা হয়েছে একটি অস্থায়ী মঞ্চের মত বানিয়ে সাদা শামিয়ানা দিয়ে ঘেরা। তার পেছনে আর একটি শামিয়ানার তলায় হাজারো ভীড়ের মধ্যে আত্মীয় পরিজন পরিবেষ্টিত হয়ে পাথরের মত বসে আছেন ওনার মা বেগম আয়েশা ফয়েজ। মায়ের পাশে দাঁড়ানো ডঃ জাফর ইকবাল। মায়ের মুখোমুখি শাওন। শাওনকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে অভিনেত্রী তানিয়া। কত যে মানুষ সে দৃশ্য যে না দেখেছে তাকে তা বলে বোঝান যাবে না।
আমি গিয়ে দাঁড়ালাম হুমায়ূন আহমেদের মায়ের পাশে। ওনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'খালাম্মা আপনি তো কোন সাধারন মা নন আপনি ৭১এ দেশের জন্য স্বামীকে হারিয়েছেন। আজ জননন্দিত সন্তান হারিয়েছেন, আপনি হুমায়ূন ভাইয়ের মা, আপনাকে তো ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।' শাওনের দিকে তাকানো যায় না এই চার পাঁচ দিনে সে যেনো ঝরে পড়া একটি শুকনো পাতার মত ফ্যাকাশে! সে থেকে থেকে কেঁদে উঠছে, অনর্গল কথা বলছে। আমাকে দেখে আবার সে গুঙিয়ে উঠলো। হাত দুখানি ধরে কেবল বললাম 'শাওন, শান্ত হও, শান্ত হও'
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর আগে ওনার শেষ ইচ্ছা কি ছিল বা কোথায় উনি সমাহিত হতে চেয়েছিলেন তা নিয়ে পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয়নি তখনো। সেই বিতর্কে, সারা পরিবার, সারা দেশের মানুষ, সারা পৃথিবীতে ছড়িতে থাকা অগনিত হুমায়ুন ভক্ত দ্বিখন্ডিত। জাফর ভাইয়ের সাথে কথা বলে বুঝলাম পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে ওনারা বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চান।।
হুমায়ূন ভাইয়ের কফিনের পাশে সৈয়দ শামসুল হক, রামেন্দু মজুমদার ও অন্যান্যের সাথে সাদা কাগজের মত দাঁড়িয়ে আছে নোভা্, শিলা আর কালো ফ্রেমের চশমা পরা নুহাস। নুহাস কিছুক্ষন পর পর বাবার কফিনের উপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। আমি শিলাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলে শীলা তার ভার ছেড়ে দিয়ে কেঁদে উঠলো। নোভাকে খুঁজছিলাম আমি নোভার কাছেই। মাথায় ওড়না বেঁধে রাখায় আমি ওকে চিনতেই পারিনি। বিপাশা আমেরিকা থেকে এখনো এসে পৌছায়নি। একটা গভীর বেদনা বুক চিরে ওঠে বারে বারে। ওরা তিন বোন আমাদের কত প্রিয় ছিল। ওরা 'এইসব দিনরাত্রি' র সেটে এসে বসে বসে খেলা করত। আমরা ওদের সবাইকে ডাকতাম টুকটুকি বলে। আমাদের ঐ নাটকে ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল যার নাম টুকটুকি। 'বহুব্রীহি' নাটকের সেটে ওরা এলে আনন্দ বয়ে যেতো। এই নাটকের মা ( আলেয়া ফেরদৌসি ) আমাদের জন্য খাবার বানিয়ে আনতেন। হুমায়ূন ভাইয়ের তিন মেয়ে, পরিচালক নওয়াজিশ আলী খানের ছেলে তোরসা আর ছোট্ট মেয়ে রেহনুমাকে সাথে নিয়ে আমরা সবাই সেই খাবার খুব মজা করে করে খেতাম। হুমায়ূন ভাইও বাদ পড়তেন না। আর নুহাস,সে তো সেদিন হল, ও আমার ছেলে সিদ্ধার্থের কয়েক মাসের ছোট।
সময় শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। ঈদ গা মাঠে নামাজে জানাজা হবে সেখানে যেতে হবে। কেউ এসে জানান দিলে সবাই গিয়ে ঘন হয়ে দাঁড়ালাম তার কফিনের পাশে। ফুলে ফুলে পাহাড়ের মত উঁচু হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা জুড়ে। এই সব মূহুর্তে মন কেমন এক অপার্থিব শূণ্যতায় ভেসে বেড়ায়। কফিনের উপর থেকে একটি তাজা বকুলের মালা তুলে নিলাম হাতে। দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিরব। 'হুমায়ূন ভাই আপনার কি মনে হচ্ছে আপনার প্রিয় বই তারাশংকরের 'কবি' থেকে সেই উদ্ধৃতি "জীবন এতো ছোট কেনে!"
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে এগিয়ে গেল তাঁর শেষযাত্রা। পিছনে অগনিত মানুষের মিছিল। ক্রন্দন। হাহাকার। ফুল। পায়ের কাছে পড়ে থাকা বর্ষার প্রথম কদম। কিছুক্ষনের মধ্যে আস্তে আস্তে শুন্য হয়ে এলো শহিদ মিনার। আজ দাফন হবে না। আজ রাতে তিনি থাকবেন বারডেমের হিমঘরে, কাল পারিবারিক সিদ্ধান্ত হলে তারপর শেষ হবে এই পার্থিব বিদায়ের আয়োজন।
অপার্থিব এক যাত্রায় তিনি একাকী চলেছেন সেই আনন্দধামে। আমার হাতের ভেতর তাঁর কফিন ছোঁয়া শেষ চিহ্ন একটি বকুলের মালা। ছোট নয় তাঁর বিশাল জীবনের সুষমায় ভরা এই ফুল। আমার মনের তেপান্তরে আমি যেনো শুনতে পাচ্ছি সেই অনন্তধামের পানে ছুটে চলা এক স্বর্গ সংগীত গীত হতে। তা যেন সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পরিব্যাপ্ত হয়ে কী এক অজানা ইন্দ্রজাল বিছিয়ে দিয়ে গেলো আমার উপলব্ধির উপকূলে। আমি শহিদ মিনার থেকে পা বাড়ালেম এই জেনে ‘তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’
চলে গেছে সবাই। শহীদ মিনারের শূণ্য সিঁড়িতে পড়ে আছে বর্ষা ভেজা কদম। আমি ক্লান্ত। দীর্ঘ জার্নিতে জেট ল্যাগ কাটেনি আমার। ফিরে যাচ্ছি ঘরে। না এদেশে আমার ঘর নেই। ফিরে যাচ্ছি চিরচেনা এই দেশে আমার ঘরহীন ঘরে। আবার সেই ডাক শুনতে পেলাম 'মিস মিলি!' কেমন যেনো নিশিতে পাওয়া মানুষের মত আমি আবার আমার চারিদিকে তাকালাম।