স্বর্গীয় দূত । শিল্পী রহমান

মেয়েটির নাম নীলাঞ্জনা, বাবা মা আদর করে নীলি বলে ডাকে। পড়তে গেছে সুইডেনে। মাস্টার্স করছে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে এই প্রথম দেশ থেকে বাইরে বের হলো মেয়েটি প্রথমবারের যে কোনকিছুর অভিজ্ঞতাই মনে রাখবার মতো।
নীলাঞ্জনা সবসময় খুবসাহসী, নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করে। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে নীলিকে বিদেশ বিভূঁইয়ে একা ছাড়তে একটু সংশয় থাকলেও কোন আপত্তি করেনি তারা, মেয়েকে খুব ভালো করেই চেনে। যে কোন কিছুর মোকাবেলা করতে ওদের চেয়ে কয়েক গুন ভালো ধৈর্য এবং বুদ্ধি রাখে মেয়েটি। তবুও বিপদ আপদের তো কোন ঠিক ঠিকানানেই।কখন কোথা দিয়ে কী বিপদ আসবে তা কেউ জানে না। ব্যাপারটা আসলে সেরকমই, কেউ জানে না। এই কথাটাই নীলাঞ্জনা ওর মা বাবাকে বলে সব সময় “ মা, ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির সামনেই যে কিছু ঘটবে না এটার কোন নিশ্চয়তা আছে?” তা অবশ্য নেই, নীলাঞ্জনার বাবা ভাবে। ও আরও বলেছে, “জানো, পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে বেশী কোথায় মারা যায়? সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায়, নিজের বাসার ভেতরে, নিজের বিছানায়। তাহলে কোথায় থাকবে তুমি নিরাপদ?” অকাট্য যুক্তি, মেয়ের সাথে যুক্তিতে পারা কঠিন তবুও সাবধানের মার নেই, অন্য একটা দেশে বুঝে শুনে চলাই ভালো।সেটা নীলাঞ্জনা জানে এবং সেভাবেই ও চলবে এ বিশ্বাস ওর বাবা মায়ের আছে।
সুইডেনের আবহাওয়া বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে আকাশপাতাল পার্থক্য। বিশেষ করে শীতকালের আবহাওয়া। ওখানে বসন্তের সময় হল মার্চ ও এপ্রিল থেকে শুরু করে মে পর্যন্ত, জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে গ্রীষ্মকাল, বাংলাদেশের সাথে এই গ্রীষ্মকালের কোন মিল নেই। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর ও নভেম্বর পর্যন্ত শরৎকাল এবং নভেম্বর ও ডিসেম্বর থেকে শুরু করে মার্চ ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে শীতকাল। ক্লাস শুরু হয় জানুয়ারি থেকে অর্থাৎ শীতকালে, আর শীতকাল মানেই বরফ।
পুরো দেশ শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে। যদি বাংলাদেশের পৌষ ও মাঘ মাসের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে সুইডেন চার ঋতুর দেশ হলেও বাংলাদেশীদের জন্য সেটা বারো মাসই শীতকাল। সুইডেনের যে সময়টিকে গ্রীষ্মকাল বলা হয়, সেটাও বাংলাদেশের শীতকালের মতো। এপ্রিল থেকে বরফ গলতে শুরু করে সুইডেনেরএক-তৃতীয়াংশ জায়গায়।সুইডেন একটি লম্বা দেশ, দক্ষিণে তাপমাত্রা৩০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড হয়ে যায়, অন্য দিকে উত্তরে কিছু কিছু জায়গায় অল্প সময়ের জন্য ৩০ ডিগ্রি থাকে, তবে বেশির ভাগ সময়েই মাইনাস ৩০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে মাইনাস ৬০ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রা থাকে। ঘর থেকে বাইরে সাধারণভাবে চলাচল করা সম্ভব হয়না। সে ক্ষেত্রে শরীরের কাপড়চোপড় থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি বিশেষভাবে তৈরি করা হয় এইদেশে। পানি যাতে জমে না যায়, তার জন্য বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে পানির সরবরাহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
নীলাঞ্জনারঠাণ্ডা লাগে বেশি তাই অন্য দেশে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করেছিল কিন্তু হয়নি। অগত্যা সুইডেনেই যেতে হল, নীলাঞ্জনা অবশ্য চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। তাই সাহস করে শীতের দেশেই চলে গেছে পড়াশুনা করতে । বঙ্গবাজার থেকে একগাদা গরম কাপড়, মোজা, গ্লাভস, জ্যাকেট ইত্যাদি কিনে দিয়েছে ওকে মা। ওরা জানে ওখানে যেয়ে ওখানকার আবহাওয়া বুঝে আরও কিছু কিনতে হবে, তবুও একেবারে কিছু না নিয়ে গেলে তো আর হয়না।
ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। একেকদিন একেক রকমের গল্পে দুর থেকেই ব্যস্ত করে রাখে নীলাঞ্জনা ওর বাবা মাকে। বেশিরভাগই শীত সংক্রান্তগল্প, সাথে থাকে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতার সমাহার। উনারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন প্রতিদিন ওর ডিনার করবার সময়টাতে।ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে মেয়েটা বাজার করে বাসায় এসে রান্না করে প্লেটটা হাতে নিয়ে ভিডিও কল করে রোজ।খেতে খেতে গড়গড় করে সারাদিনের গল্প বলতে থাকে। এটা অবশ্য ওর ছোট বেলার স্বভাব। ওর সব গল্প শুনতেই হবে ওর বাবা মাকে, রেহাই নেই। বাবা মাও খুব মন দিয়ে শোনে, মাঝে বাঁধা দেয়া যাবে না । ও যখন থামবে তখন কিছু জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই অনেক বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে নীলাঞ্জনা। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বিভিন্ন রকমের ছেলে মেয়ে, সবার সাথে সহজ হয়ে মিশতে পারে মেয়েটা। তবে এর মধ্যেই আবার যাদের সাথে ওর মনের মিল হল তাদের সাথে বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলো। ৫/৬ জনের নাম প্রতিদিনের গল্পেই থাকে। এরা সবাই মিলে পড়ালেখার পাশাপাশি দেশটাকে আবিষ্কার করছে।কোথায় কোন খাবার পাওয়া যায়, কেমনদাম, গরম কাপড় কোথায় ভালো এবং সস্তায় পাওয়া যায় ইত্যাদি বিষয়ে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে ওদের মধ্যে।বিদেশের মাটিতে এটা খুব হয়, একসঙ্গে জীবন খুঁজে নেয়ার মতো একটা অভিজ্ঞতা ।
শুরুর দিকে দেখা হলেই বন্ধুদের সাথে এসব বিষয় নিয়ে গল্প হয় বেশি। আরও গল্প হয়, কে কীভাবে কোথায় বেকুব বনে গেলো কিংবা খুব বুদ্ধিমানের সাথে কোন পরিস্থিতি সামলে নিল ইত্যাদি। কেউ বিপদে পড়লে বা অসুস্থ হলে, পাশে এসে দাঁড়ানো মানুষগুলোই তখন সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়। অনেক কথা আছে বাবা মাকেও বলা যায় না, তাঁরা দূর থেকে দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে। তখন বন্ধুরাই সব।
জুন পর্যন্ত টানা ক্লাস করে প্রথম সেমেস্টার শেষ হল, মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট করলো নীলাঞ্জনা । দু’সপ্তাহের ছুটি। কী করা যায়? সুন্দর আবহাওয়া, ২০ ডিগ্রী তো স্বপ্নের মতো। বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করতে শুরু করলো কী করা যায়।
ইউরোপের একটা সুবিধা হল এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটা কোন ব্যাপারই না। হুট হাট চলে যাচ্ছে মানুষ। খরচও তেমন না। ট্রেনে যাওয়া যায়। প্লেনে গেলেও খুব কম ক্রনা দিয়েই টিকেট কেটে সপ্তাহান্তে আরেকটা দেশ দেখে আসা যায়। এই সুবিধা কেউ সহজে হারাতে চায় না। বিশেষ করে টগবগে তরুণ তরুণীরা ঘরে বসে থাকার মানুষ নয়। আর নীলাঞ্জনার তো আবিস্কারের নেশা রয়ে, নীলাঞ্জনাও তাই করতে চাইলো সেমেস্টার ব্রেকে।
টুকটাক সুইডিশ ভাষা শিখতে শুরু করেছে নীলাঞ্জনা। ওর বাবা মা দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে মেয়ের বেড়ে ওঠা দেখে। খুব ভালো লাগে তাঁদের। খুব কাছের দেশ ফিনল্যান্ড। প্রথম ট্রিপের জন্য ওরা ওই দেশটাই বেছে নিল।ফিনল্যান্ডের শহর থেকে দূরে ওদের সবার প্রিয় শিল্পী Burna Boy এর কনসার্ট হবে সেখানে যাবে ওরা সবাই মিলে, কিন্তু যেয়ে উঠবে শহরেই। খুব সহজে ফেরিতে করে যাওয়া যায় ফিনল্যান্ডে। সবাই মিলে মজা করতে করতে রাতের ফেরিতে পৌঁছে গেলো রাজধানী হেলসিঙ্কিতে।
সুন্দর শহর হেলসিঙ্কি। এখানকার আবহাওয়ায় খুব একটা পার্থক্য নেই। জুন মাস বলে বরফ কমেছে বেশ। তারপরেও লেকের ওপরে পাতলা বরফের আবরণ লক্ষ্য করা যায়। লেকের ধারে কফিশপগুলোর উঠোনে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ গোল হয়ে বসে ধুমায়িত কফি খাচ্ছে। এমন দৃশ্য কফি পছন্দ না করা মানুষকেওকাছে টানে।নীলাঞ্জনা তার বন্ধুদের নিয়ে এমনই একটা কফিশপেবসে কফি খেলো, সাথে ক্যারট কেক এবং বাড়তি ক্রিম। টাকা পয়সাহিসেব করে চলতে হয় তবুও একটা দেশে এসেছে , একটু সাধ আহ্লাদনা করলে কী চলে?
দু’রাতের জন্য এসেছে ওরা এখানে। প্রথম দিন হেলসিঙ্কিটা ঘুরে দেখবে, রাতে যাবে কনসার্টে, তারপরের দিন সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আবার রাতের ফেরিতে ফিরে যাবে সুইডেন। খুব এঞ্জয় করলো ওরা সারাদিন, বিকেলে হোটেলে ফিরে রেডি হয়ে বাসে করে চলে গেলো সেই কনসার্ট দেখতে। দু’ঘন্টার প্রোগ্রাম। টিকেট আগে থেকে কেনা ছিল, কিন্তু এক ঘন্টা গান শোনার পর নীলাঞ্জনা হঠাৎ খুব অসুস্থ বোধ করতে শুরু করলো। ওয়াশ রুমে যেয়ে চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো দু’বার। কিন্তু কিছুতেই ঠিক লাগছে না। বেশ জ্বর জ্বর লাগছে, মাথাটাও খুব ব্যথা করছে। এমন সময় কোন দোকানও খোলা নেই যে একটা ওষুধ কিনে খাবে। তাছাড়া এই জায়গাটা শহর থেকে বেশ দূরে। নীলাঞ্জনা ভাবলো ও আর এখনে থাকতে পারবে না। মাথা ব্যথায় এত আওয়াজও নিতে পারছে না, মনে হচ্ছে মাথাটা ফেটে যাবে ব্যথায়।হঠাৎ কী হল ওর বুঝতে পারছে না!
নীলাঞ্জনা ওর বন্ধুদের বলল ও বাসে করে হোটেলে ফিরে যাবে। ওর এক বন্ধু ওর সাথে যেতে চাইল, কিন্তু নীলাঞ্জনা বললো , “না , রোজ তো আর এমন কনসার্ট দেখতে আসা হয়না, তুমি মিস করবে কেন ? তুমি থাকো, আমি ঠিক চলে যেতে পারবো, সমস্যা হবে না “।বেরিয়ে এলো নীলাঞ্জনা অডিটরিয়াম থেকে। একটু হাঁটলেই বাসস্টপ। অনেক বেশি লোকজনের আনাগোনা নেই বাইরে, দুয়েক জন হয়ত কনসার্ট থেকে বেরিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। ভেতরের সরগরম পরিবেশের সাথে বাইরের নির্জন পরিবেশে একটু অস্বস্তি লাগে নীলাঞ্জনার। বাসের সময় দেখেই ভেতর থেকে বাইরে বের হয়েছে যেন ওকে বেশিক্ষণ বাসস্টপে অপেক্ষা না করতে হয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস এসে গেলো। নীলাঞ্জনা বাসে উঠে দেখল, তেমন একটা মানুষ নেই বাসে, মাত্র কয়েকজন। রাত হয়ে গেছে, আর এসব দেশে রাত ৮ টার পর এমনিতেও মানুষ খুব একটা দেখা যায়না।সবাই ঘরে ফিরে যায়, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে এবং খুব ভোরে ওঠে যায়।
নীলাঞ্জনা বাসে উঠে সামনের দিকের একটা সিটে বসে পড়লো, ৪০মিনিটের জার্নি, রুমে ফিরেই ও ২টা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়বে।
যে কয়জন বাসে ছিল তারাও এক এক করে নেমে যেতে শুরু করলো। একটু পরে ও লক্ষ্য করলো ৩টা ছেলে ওর দিকে বার বার তাকাচ্ছে আর নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, নীলাঞ্জনার একটু অস্বস্তি লাগল।শরীরটা এমনিতেই ভালো নেই তার ওপর এসব নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না ওর। একটু পর তিনটা ছেলেই ওর সামনেরসিটে এসে বসলো। এইবার নীলাঞ্জনা একটু ভয় পেলো। একটা ছেলে ফোনে কথা বলতে উঠে গিয়ে আবার ফিরে এলো। পরের বাস স্টপ থেকে আরও দুজন উঠলো বাসে। এই দুজন মনে হয় আগের তিনজনের বন্ধু। এই পাঁচজন ছাড়া বাসে আর এখন কেউ নেই।নীলাঞ্জনা উঠে গিয়ে বাস ড্রাইভারের একবারে কাছের সিটটাতে যেয়ে বসতে চাইল। কিন্তু ও উঠে দাঁড়াবার সাথে সাথে একজন ওদের নিজের ভাষায় কথা বলতে লাগলো আর ওকে টেনে বসিয়ে দিতে চাইল আগের জায়গায়। কেউ ওর চুল ধরে নাড়ছে, কেউ জামা ধরে টানছে। নীলাঞ্জনার ভেতরটা ভয়ে হিম ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।হাত দিয়ে সরিয়েদিতে চেষ্টা করছে, মুখ দিয়ে বলছে “ লিভ মি অ্যালন, হোয়াই আরইউ বোদারিং মি ?”।
ওরা ওর কথা বুঝতে পারছে কিনা নীলাঞ্জনা জানে না।যত সাহসীই হোক এমন একটা পরিস্থিতিতে ও কী করবে? কী করা উচিৎ? খুব দ্রুত ভাবছে নীলাঞ্জনা, পরের স্টপে নেমে যাবে? কিন্তু ওখানে নেমে কী করবে? কিছু চেনে না, কাউকে জানে না, তাছাড়া এরাও যদি নেমে যায় ওখানে? উফ আর ভাবতে পারছে নানীলাঞ্জনা। খুব ভয় হচ্ছে, আজ বোধহয় ওর কপালে রেইপ লেখা আছে। ইয়া আল্লাহ্ রক্ষা করো , মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করল। নিজেকে জোর করে টেনে তুলে ড্রাইভারের কাছের সিটটাতে বসল । ড্রাইভার কি কিছু বুঝতে পারছে না? কিছু বলছে না কেন? আরও ৪ টা স্টপ বাকি। কখন শেষ এই হবে সুদীর্ঘ যাত্রা!
বাসটা আবার থামল, নীলাঞ্জনা ভয় পেলো আরও ছেলে উঠবে নাকি এই স্টপ থেকে, তাহলে আর ওর মুক্তি নেই। ভয়ে চুপসে গেছে মেয়েটা। বাবা মায়ের চেহারাটা ভেসে উঠছে মনে। আজকেই বোধহয় ওর জীবনের শেষরাত । কেন যে একা একা ফিরতে চাইলো? কেন যে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো?
বাসটা যেখানে থামলো, সেখানে একটা মাত্র লাইট জ্বলছে।অন্ধকারের যেমন একটা গম্ভীর রূপ আছে, অল্প আলোরও একটা রহস্যময় রূপ রয়েছে। শুধু ঝলমলে আলোই এখন ওর একমাত্র কামনা। গাম্ভীর্যতা বা রহস্য কোনটাই ওকে স্বস্তি দিচ্ছে না। বাসের ভেতরে ভয়, বাইরে ভয়, কোথাও নামতে ভয়, সামনে যেতে ভয়, এমনএকটা নিরুপায় পরিস্থিতি কখনোই কল্পনা করেনি নীলাঞ্জনা। খুবভয়ে ভয়ে বাইরে তাকালো, সেই রহস্যময় অল্প আলোতে একটু বাড়তি জ্যোতি নিয়ে ধবধবে সাদা চুলের এক বৃদ্ধা মহিলা এসে দাঁড়ালো বাসের দরজার সামনে। এই মহিলাকে দেখে কেমন যেন একটা শান্তিশান্তি ভাব লাগলো ওর মনে। মহিলার পুরো অবয়বে একটা ঐশ্বরিক ব্যাপার রয়েছে। ধবধবে সাদা চুলগুলো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেনজ্যোতি বের হচ্ছে সেখান থেকে। গায়েও সাদা লম্বা একটা জামা, সবকিছু মিলিয়ে একটা এঞ্জেলিক ভাব। মহিলা এসে নীলাঞ্জনার পাশে বসল। আহ, এতক্ষণ পরে যেন নীলাঞ্জনার ধড়ে প্রাণ এলো। এখনঅন্তত ও একা নয়।
ছেলেগুলো হাল ছাড়েনি, দূর থেকে মন্তব্য করেই যাচ্ছে। দুয়েক জন কাছে বসার চেষ্টা করছে। নীলাঞ্জনা নিজের অজান্তে সাথেসাথে মহিলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।মহিলা নীলাঞ্জনারদিকে খুব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হাসল, মনে হল সেই হাসিতে ছড়ানো ছিল আশ্বস্ত করবার অঙ্গীকার। ছেলেগুলো কাছে আসতেই মহিলা দাঁড়িয়ে সরাসরি ওদের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত কণ্ঠে ওদের সরে যেতে বলল। আরও কিছু হয়তো বলল যা নীলাঞ্জনা বুঝতে পারলোনা কিন্তু দেখল ছেলেগুলো আগের জায়গায় যেয়ে বসেছে। এর কিছু পরেই বাসটা ওর স্টপে এসে গেলো। নীলাঞ্জনা নেমে গেলো, দেখল মহিলাও ওর সাথে নেমে পড়েছে। নীলাঞ্জনা জড়িয়ে ধরলো মহিলাকে , কৃতজ্ঞতায় কেঁদে ফেললো।
মহিলা ওর পিঠে হাত বুলিয়েদিল, কোনরকম কথা না বলেও যে কতো বেশি কমিউনিকেট করা যায় এটা আজই প্রথম উপলব্ধি করতে পারলো নীলাঞ্জনা প্রায় দৌড়েদৌড়ে হাঁটছে, যত দ্রুত হোটেলে পৌঁছানো যায়।লক্ষ্য করলো সেইএঞ্জেলিক মহিলাও ওর পেছন পেছন আসছে ওর মনে হল স্বর্গীয় এই ফেরেস্তা ওর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই ফিরে যাবেন।নীলাঞ্জনা ইশারায় মহিলাকে আরেকবার ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে মহিলা কোথাও নেই আরে একেবারে হাওয়া হয়ে গেলো কী করে? এতকিছু ভাবারসময় নেই, নীলাঞ্জনা রুমে যেতে হবে।
রুমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, এই জানালা দিয়ে পুরো সামনের রাস্তাটা দেখা যায়।নীলাঞ্জনা অবাক হয়ে দেখল কোথাও কোন মানুষনেই।এতো ট্রমার মধ্যে মাথা ব্যথা, জ্বর সবকিছুই তুচ্ছ মনে হল ওর।এতক্ষণ যেন কিছু টেরই পাচ্ছিল না, এখন রুমে ফিরে দেখে প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপছে সমস্ত শরীর।ড্রয়ার থেকে ট্যাবলেট বের করে খেয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
মহিলার সবকিছু এতো অন্যরকম ছিল, কোনোদিন ভুলবে নানীলাঞ্জনা।তাঁর গায়ের গন্ধ, কাপড়, চুল, চোখের দৃষ্টি সবকিছু ছিল প্রশান্তিময়।তাছাড়া এতো রাতে এই বয়সের এক মহিলার জেগে থাকারও কথা না। এটা ভাবতেই গা ছমছম করে উঠলো নীলাঞ্জনার।তাহলে কী এই মহিলা ওর প্রার্থনার জবাব হিসেবে ওর কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো সময় মতো? বিধাতাই কী ওর কাছে এমন একজন ফেরেস্তাকে মানুষ রূপে পাঠিয়ে দিয়েছেন?
জীবনে এমন অনেক প্রশ্নের জবাব মেলে না, না মিলুক। কিছু প্রশ্নের উত্তর না পেলেই বরং হৃদয়ের আরও গভীরে যেয়ে স্পষ্ট ছাপ ফেলতে পারে।
( সত্য ঘটনা অবলম্বনে)