নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে আছে শঙ্কাও । সোহরাব হাসান
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎটি নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। আনুষ্ঠানিকতা হলো ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো। প্রতি বছরই সরকার প্রধানকে এই আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং তিনি হাজিরও থাকেন। কেননা সরকার প্রধান একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বপ্রাপ্ত।
কিন্তু এবারের সাক্ষাৎকারটি তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আর এ কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদেরও সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত।
সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, ১ নভেম্বর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য সাধুবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা। আসন্ন নির্বাচন যেন নিখুঁত নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকে, সে জন্যও তিন বাহিনীকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। নির্বাচন ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ৯০ হাজার সেনাসদস্য, নৌবাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য এবং বিমানবাহিনীর দেড় হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবেন।
উল্লেখ্য, সংশোধিত আরওপিওতে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও নির্বাচনী কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরূপ দায়িত্ব পালন করবেন। বিগত সরকারের আমলে তারা সহযোগী বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। দুর্বল পুলিশি ব্যবস্থার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যেরাও সক্রিয় আছেন।
সরকার যখন মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার বিষয়ে বদ্ধপরিকর, তখনও জুলাই সনদ ও গণভোটের দিন-তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বাহাসে লিপ্ত।
অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; যদিও এর প্রথম দাবিদার জাতীয় নাগরিক পার্টি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে না পেরে এখনো পর্যন্ত সই করেনি।
জুলাই সনদ সইয়ের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন— জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে কি না? আর সে ক্ষেত্রে নির্বাচন নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল; আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল; তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি।
মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশন গণভোটের তারিখ নির্দিষ্ট করেনি। তারা বলেছে, সংসদ নির্বাচনের দিনও হতে পারে, আবার আগেও হতে পারে। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের মতে, আগে গণভোটের দাবি সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
ধারণা করা গিয়েছিল, ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এবারেও সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনায় করে একটা সমঝোতায় আসবে— এটাই সরকার প্রত্যাশা করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেশির ভাগ দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট করার পক্ষে। তাদের কথা হলো, ফেব্রুয়ারির আগে যে সময় আছে, তাতে আলাদাভাবে গণভোট করা কঠিন। দ্বিতীয় আলাদা গণভোট করলে ভোটার উপস্থিতিও অনেক কম হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে হলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাই ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসবেন তাদের স্বার্থে।
বিএনপি ও সহযোগী দলগুলোর অভিযোগ, তাদের আপত্তিগুলো জুলাই সনদে সন্নিবেশিত থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চূড়ান্ত যে সুপারিশ করেছে, তাতে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতারণা বলেও অভিহিত করেছেন তারা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর দাবি হলো, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট না হলে জুলাই সনদ আইনি ভিত্তি পাবে না। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি গণভোটের দিন-তারিখের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা পেলে তারা সনদে সই করবে এবং নির্বাচনে যাবে বলেও জানিয়েছে। দলীয় প্রতীক নিয়ে যেই সমস্যা ছিল, তারও সমাধান হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা ফুটন্ত শাপলা না পেয়ে শাপলা কলি মেনে নিয়েছে।
বিএনপি ও সমমনাদের আরেকটি আপত্তি হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে এ রকম বিধান থাকলেও সেটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি তথা সংসদের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায়। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য— তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থা রাখতে পারছে না। তারপরও দেশবাসী মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় নির্বাচন নিয়ে জনমনে যেই সংশয় ও সন্দেহ আছে, সেটা কাটবে না।
সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে?
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন আরওপিও সংশোধনীর নামে একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক সামনে নিয়ে এসেছে। আগে জোটগত নির্বাচন করলেও জোটভুক্ত দলগুলো পছন্দসই প্রতীক বেছে নিতে পারত। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে; জোটভুক্ত অন্য দলের প্রতীক নিতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর বিএনপিসহ বেশ কিছু দল আপত্তি জানিয়েছে। তাদের কথা হলো, এর মাধ্যমে প্রার্থীর স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল সংশোধনীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। যেখানে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে, সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিয়ে নির্বাচন কমিশন একটি হঠকারী কাজই করেছে বলে ধারণা করি।
অন্যান্য সমস্যার সমাধান সরকারের হাতে থাকলেও আরওপি সংশোধনী নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান নির্বাচন কমিশনকেই খুঁজে বের করতে হবে।




