ঝাপসা চোখে পড়ে শেষ করা বইয়ের নাম ‘হোয়েন ব্রিথ বিকামস এয়ার’ । আতিকুর রহমান শুভ

ঝাপসা চোখে পড়ে শেষ করা বইয়ের নাম ‘হোয়েন ব্রিথ বিকামস এয়ার’ । আতিকুর রহমান শুভ

[ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামি একবার বলেছিলেন— যদি আপনি এমন একটি বই পড়েন যা অন্যরা সবাই পড়ছে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন অন্য সবাই কী ভাবছে। আপনি নিজে বই পড়ুন এবং অন্যকে উৎসাহিত করুন।

বইপত্র বিভাগে আমরা ঠিক কোনো বইয়ের রিভিউ বা সমালোচনা করি না। এখানে বই পড়ে আপনার কেমন লেগেছে সেই অনুভূতিটাই প্রকাশ পায়। এককথায়, আমরা পাঠ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করি। প্রিয় পাঠক, আপনার পঠিত কোনো বইয়ের প্রতিক্রিয়া লিখে পাঠান। আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়াও প্রকাশিত হোক প্রশান্তিকায়।]

বইপোকা ‘সুখ পাখি’, যিনি বাতিঘর থেকে আমাদের প্রশান্তিকা বইঘর-এর জন্য একসময় বই পাঠাতেন, লিখেছিলেন একটি বই নিয়ে।  আমি বলেছিলাম— দুই কপি ‘নি:শ্বাস যখন বাতাস’ (When Breath Becomes Air) আমারও লাগবে। নিজের জন্য একটা আরেকটা প্রিয় কারও জন্য।

গতকাল পৌঁছে যাওয়া শত শত বইয়ের মধ্যে এটিকেই আগে জাপটে ধরেছি। ঝাপসা চোখ নিয়ে আমিও পড়ছি।

আজও মনে আছে, আমার বাবার ফুসফুসের ক্যান্সারের রিপোর্ট মহাখালি যক্ষ্মা হাসপাতাল থেকে আমিই তুলেছিলাম। সাথে ছিলেন আমার অভিভাবক তারেক দুলাভাই। তারপর কত চিকিৎসা, কত ঢাকা–কলকাতা, কলকাতা–ঢাকা করেছি। বাবাকে কোনোদিন বলিনি— আপনার কী হয়েছে! কলকাতার ডাক্তারদেরও নিষেধ করেছিলাম। তারাও বাবাকে বলেছেন— আপনার একটা টিউমার হয়েছে কেবল। ও ঠিক হয়ে যাবে।

১৯৯৯ সালের নভেম্বরে, আমি অস্ট্রেলিয়া আসার কয়েক মাস আগে বাবা চলে যাওয়ার পরে মা জানতে পেরেছিলেন বাবার কী হয়েছিল। আমরা গুটিকয়েক মানুষ বাবার অসুখটা সম্পর্কে জানতাম। আমাদের চোখ সবসময় ঝাপসা থাকত।

এই বইয়ের কথক বা লেখকেরও ফুসফুসের ক্যান্সার হয়েছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি লিখে গেছেন। আমার বাবা লিখে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁর বেদনা আমরা দেখেছি।

যে বইটির কথা বলছি তার নাম— When Breath Becomes Air। লেখক পল কালানিথি।

পল কালানিথি ছিলেন একজন মেধাবী নিউরোসার্জন। তিনি পড়াশোনা করছিলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। হঠাৎ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসক থেকে রোগীতে পরিণত হন। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের অর্থ, সময়ের মূল্য ও অস্তিত্বের প্রশ্ন নিয়ে ভাবেন। কন্যার জন্ম তাঁকে নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা লিখে যান, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জীবনের দৈর্ঘ্য নয়, বরং গভীরতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

বইয়ের অন্যতম মূল বিষয় হলো—ডাক্তারের চশমা থেকে রোগীর চশমায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তিনি বুঝতে পারেন, রোগীর যন্ত্রণা ও মৃত্যুভয়ের অনুভূতি চিকিৎসক হিসেবে তিনি আগে এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি।

ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তিনি প্রশ্ন তোলেন—জীবনের অর্থ কী? মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ কীভাবে বাঁচতে চায়? তিনি লেখেন, মৃত্যু অবধারিত হলেও মানুষ বেঁচে থাকা সময়ের মধ্যেই অর্থ খুঁজে পায়।

সুখ পাখির লেখা

পল কালানিথি, বয়স ৩৬ বছর, একজন নিউরোসার্জন। নিজের কাজে তিনি সেরাদের একজন। আর কয়েক বছর পর প্রফেসর হয়ে যাবেন, তখন গিয়ে আরামে শ্বাস ফেলতে পারবেন। এখন চলছে উরাধুরা কাজ। খাওয়া–দাওয়া দূরের কথা, দুদণ্ড শ্বাস ফেলারও সময় নেই।

… ক্যান্সারের ট্রিটমেন্ট চলছে পল কালানিথির। ভীষণ দুর্বল শরীর নিয়ে হুইলচেয়ারে বসে এক হাতে ধরে আছেন স্ত্রীর হাত, আরেক হাতে কোলে নিয়েছেন সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েকে। একদিকে নিজের জীবন একটু একটু করে আঙুলের ফাঁক গলে বের হয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে জন্ম নিচ্ছে নতুন একটি জীবন।

এই দৃশ্যের পর আর নিজেকে সামলানো যায়নি। বাকি বই শেষ করেছি ঝাপসা চোখে।

এই জীবনে Grave of the Fireflies মুভিটার মতো এই বইটাও দ্বিতীয়বার পড়ব না। প্রথমবারেই এমন ছাপ ফেলেছে, যা সারাজীবনে ভুলব না।

কালানিথি সাহেব, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। 💛

When Breath Becomes Air

By: Paul Kalanithi

Publisher: Random House

বি.দ্র. বেঁচে থাকার শেষ কয়েক মাসে শেষ জীবনীশক্তি দিয়ে লিখেছিলেন এই বই, তবে শেষ করে যেতে পারেননি। বইয়ের শেষ অংশ লিখেছেন তাঁর স্ত্রী লুসি কালানিথি।

আতিকুর রহমান শুভ: সম্পাদক, প্রশান্তিকা।