শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান । অজয় দাশগুপ্ত

শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান । অজয় দাশগুপ্ত

প্রশান্তিকা নামটি দেয়ার সময় মনে মনে ভাবছিলাম শান্তি বিষয়টি আমাদের জীবনে কেন জানি অধরাই থেকে গেল। আমরা বাঙালিরা দুনিয়ার যে দেশে যে প্রান্তে থাকি না কেন আমাদের ধমনীতে রক্ত প্রবাহে থাকে দেশ ও সংস্কৃতি। সে কারণে আমরা যেমন নানাবিধ সমস্যা সংকটে ভুগি আবার এই এক কারণে আমাদের পরিচয় সতত: উজ্জ্বল। এই উজ্জ্বলতা সব জাতিসত্তার ভেতর থাকে না । সেদিক থেকে আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হবে। 

প্রশান্তিকার সাথে শান্তি ও সৌহার্দ্য জড়াজড়ি থাকুক এই কামনা  আমাকে নিরাশ করেনি। নয় নয় করে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসেছে এই পথ পরিক্রমার দিকে ফিরে তাকালে মনে হয় যা হয়েছে তাই চেয়েছিলাম আমরা। বিশেষ করে হানাহানি আর অবিশ্বাস আমাদের জীবন সঙ্গী। আমরা এমন এক জাতি যারা কাউকে ছাড় দেইনা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুল লালন সাঁই হাছন রাজা থেকে বঙ্গবন্ধু সবাই আমাদের আক্রমণের শিকার। এই খেলা খেলতে খেলতে আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছি যেখানে কে আপন কে পর সেটা বোঝাও মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 


প্রশান্তিকা এই জায়গায় কি কিছু করতে পারে ? তার কি সেই সাহস আর সক্ষমতা আছে? দেখুন, আপাত: দৃষ্টিতে না মনে হলেও শিল্প বা সংস্কৃতিই মূলত: মানুষকে জাগায়। জাগানোর শক্তি দেয়। নাট্যকার কবি ব্রেখট (মতান্তরে ব্রেশট) এর কবিতায় আছে :
মানুষের একটাই গলদ,
মানুষ ভাবতে জানে । 


ভাবতে জানে বলেই মানুষ যে কোন কঠিন সময় পাড়ি দিতে পারে। অন্য সব প্রাণীর চাইতে আমরা এগিয়ে কারণ আমরা কথা বলি। লিখতে পারি। এই কথা বলাটা যে কী অনুপম শক্তির সঞ্চার করে তার প্রমাণ পেয়েছি করোনার সময়। তখন করোনার আঘাতে পৃথিবী বিচ্ছিন্ন। আপন জনের সাথেও দূরত্ব রাখতে বাধ্য হচ্ছিল মানুষ। মা বাবা ভাই বোন সবাই এক আলাদা আলাদা জগতের বাসিন্দা। জন্ম মৃত্যু বিরহ আনন্দ কিছুই আমাদের একসাথে রাখতে পারছিল না। তখনো প্রশান্তিকা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। একদিন। সম্পাদক আতিকুর রহমান শুভ আমাকে বললো, আমরা কি অনলাইনে বা আর্ন্তজালে একত্রিত হতে পারি না? 

তাইতো! কেন পারবো না ? বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেছিলেন বাংলা একাডেমির তখনকার পরিচালক প্রিয় কবি প্রয়াত হাবিবুল্লাহ সিরাজী। ভদ্রলোক সময় বাঁচিয়ে অনলাইনে হাজির হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর স্মরণানুষ্ঠানে। আজ তিনি প্রয়াত, তাঁর কবিতাগ্রন্থ ' মধ্যরাতে দুলে ওঠো গ্লাস" এর মতো সেই সুখস্মৃতি এখনো দুলে ওঠে আমাদের মনে।

বলার সাথে সাথে সঙ্গ দিতে রাজি হয়েছিল অভিনেত্রী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লুৎফন নাহার লতা। সে থাকে আমেরিকায়। আকাশ পাতাল দূরত্ব সিডনির সাথে, সময়ের ব্যবধানও বিশাল বিষয় । কিন্তু মনের টান আর ভালোবাসা থাকলেই বাঙালি'র " আমরা হেলায় লংকা করেছি জয়"।  তার ভোর সকালে ঘুম থেকে জেগে যুক্ত হয়েছিল লতা। অনবদ্য পরিবেশনায় আমাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছিল। দেশের অন্যতম সেরা বাচিক শিল্পী অনুজপ্রতিম রাশেদ হাসান। তাকে আমি ভালোবাসি। ভালোবাসার টানে প্রশান্তিকার  সে অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে অসামান্য কবিতা পাঠে মুগ্ধ করেছিল রাশেদ। 

এটি একটি মাত্র অনুষ্ঠান। এমন আরো কতো ঘটেছে। সাংবাদিক সাহিত্যিক বাতিঘরের কর্ণধার সিডনির লেখক শিল্পী নাট্যজন কবি সবাইকে নিয়ে আড্ডা অনুষ্ঠান করেছে প্রশান্তিকা। তার প্রায়  সবগুলোই দর্শক শ্রোতা নন্দিত। 


মূলত: একটি লাইব্রেরি ধারণা নিয়ে এগুলেও ডালপালা বিস্তার করতে করতে প্রশান্তিকা এখন সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। এই পথযাত্রায় তাকে সাহায্য করেছে মানুষের ভালোবাসা আর ঈর্ষা। ঈর্ষা না থাকলে মানুষ এগুবার যে তেজ সেটা পায় না। আর ভালোবাসা না পেলে তার স্বপ্নের চারা শুকিয়ে যায় । যতদিন ভালোবাসা আর ঈর্ষা থাকবে ততদিন প্রশান্তিকাও বেঁচে থাকবে। 


সময় পাল্টেছে। মুদ্রণ শিল্পের সাথে সাথে আরো জনপ্রিয় আরো কার্যকর ভূমিকা নিয়ে হাজির হয়েছে অনলাইন মিডিয়া। এই আধুনিকতায় প্রশান্তিকা কিছু বিরতির পর আবার নতুন রূপে আসবে, এমনটাই বললো শুভ আর তার ছোট ভাই লেখক উপন্যাসিক আরিফুর রহমান। তাদের কথায় আমার আস্থা আছে। সিডনির বাংলা ও বাঙালি মনোজগতে ছোট ছোট পদরেখা ফেলে যাওয়া প্রশান্তিকা এবার আরো বড় কোন ছাপ ফেলবে এই আশা অমূলক নয়। 


প্রত্যাশা রাখি, জীবন যাপন নয় জীবনকে উদযাপনের মতো আনন্দময় ও শান্তিময় করে তুলবে প্রশান্তিকা। রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছিলেন,
শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান।