ইশিকার চোখে বাংলাদেশ : সিডনির শ্রেণিকক্ষে জাতীয় পরিচয় । শাখাওয়াৎ নয়ন 

ইশিকার চোখে বাংলাদেশ : সিডনির শ্রেণিকক্ষে জাতীয় পরিচয় । শাখাওয়াৎ নয়ন 
ইশিকা হাফিজ (ইয়ার ফাইভ) ও তার নোটেবল পার্সন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি- সংগ্রহ।

১৪ নভেম্বর ২০২৫–এর সন্ধ্যায় সিডনির আলেক্সান্দ্রিয়া পার্ক কমিউনিটি স্কুল–এর হলঘর আলো ঝলমল করে উঠেছিল। পরিবার, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভিড়ে মুখরিত ছিল বার্ষিক Night of the Notable Person অনুষ্ঠান। ইয়ার ৫ ও ইয়ার ৬ OC (অপরচুনিটি ক্লাস)–এর মেধাবী শিক্ষার্থীদের নানা প্রকল্পের ভিড়ে একটি প্রদর্শনী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে—তার জাঁকজমকের জন্য নয়, বরং তার গভীরতার জন্য। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল ইশিকা হাফিজ, ইয়ার ৫–এর এক শিক্ষার্থী, যার তৈরি পোস্টার যেন বাংলাদেশের ইতিহাস, গৌরব ও সংস্কৃতিকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে।

হলঘরের এক কোণে—যেখানে শিক্ষার্থীদের হাসি, পায়ের আওয়াজ আর রঙিন কাগজের শব্দ মিলেমিশে এক মনোরম পরিবেশ তৈরি করেছিল—সেখানে ছিল ইশিকার সুচিন্তিত প্রকল্পটি। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে সাজানো এই প্রদর্শনী ছিল রঙ, অর্থ ও অনুভূতির এক অপূর্ব সমন্বয়। হাতে আঁকা ছোট্ট বাংলাদেশি পতাকা, যত্ন করে তৈরি করা টাইমলাইন, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির স্কেচ, আর ইশিকার নিজের লেখা নিবন্ধ—সব মিলিয়ে প্রকল্পটি যেন ইতিহাসের সঙ্গে তার এক আত্মিক সংলাপ।

ডায়াসপোরা শিশুদের জন্য নিজের মাতৃভূমির সঙ্গে সংযোগ ধরে রাখা প্রায়ই একটি চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইশিকা তার পরিচয়কে বহন করছে নিভু–নিভু স্মৃতির মতো নয়, বরং উজ্জ্বল শিখার মতো—আলোকিত, উষ্ণ ও গভীর। নানান সংস্কৃতির স্পর্শে বড় হওয়া অস্ট্রেলিয়ার এই স্কুলে সে নিজের শিকড়কে যেভাবে তুলে ধরেছে, তা একটি শিশুর কাছ থেকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি অনুপ্রেরণাদায়ক।

তার সহপাঠীরা কৌতূহলভরে জড়ো হয়েছিল পোস্টারের সামনে। বঙ্গবন্ধু কে—তার বজ্রকণ্ঠ, তার সাহস, তার স্বাধীনতার স্বপ্ন—এসব ব্যাখ্যা করতে করতে ইশিকা যেন এক মূহূর্তে ইতিহাসকে জীবন্ত করে তুলেছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল না যে সে কেবল মুখস্থ বলছে; বরং মনে হচ্ছিল সে যেন নিজের ভেতর থেকে গল্পগুলো টেনে আনছে—যেন সেগুলো তার নিজের স্মৃতি, নিজের উত্তরাধিকার।

সিডনির বহুসাংস্কৃতিক বাস্তবতায় ইশিকার প্রকল্পটি এক সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। তার পোস্টার যেন সহপাঠীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে দূর বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে—বোঝার জন্য, অনুভব করার জন্য, এবং উপলব্ধি করার জন্য। তার এই আত্মবিশ্বাস অন্য ডায়াসপোরা শিশুদেরও সাহস জুগিয়েছে তাদের নিজের সংস্কৃতি উপস্থাপন করতে, গর্বের সঙ্গে বলতে: “এটাই আমার আসল পরিচয়।”

একটি শিশুর চোখ দিয়ে দেখা জাতীয় পরিচয় কোমল, নির্মল ও শক্তিশালী। ইশিকার দেশপ্রেম কঠোর কোনো রাজনীতির উপর দাঁড়ায় না; বরং দাঁড়ায় স্নেহ, স্মৃতি ও গর্বের উপর—দুটি দেশেই যার বাস, দুটি সংস্কৃতিতেই যার শিকড়।

তার প্রকল্পের প্রতিটি রঙ, প্রতিটি বাক্য যেন নিঃশব্দে গেয়ে উঠেছে—“আমার সোনার বাংলা।” সিডনির এক শ্রেণিকক্ষে একটি ছোট মেয়ে যেভাবে তার বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে, তা সত্যিই বিস্ময়ের।

ইশিকা যখন পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসছিল, তার বাবা-মা গর্বভরে তাকিয়ে ছিলেন। শিক্ষকরা তার গবেষণার গভীরতা দেখে মুগ্ধ। সহপাঠীরা তার গল্পে বিমুগ্ধ। সেই আলোকোজ্জ্বল স্কুল হলঘরে ইশিকা তখন আর কেবল ইয়ার ৫–এর এক OC শিক্ষার্থী ছিল না; সে ছিল তার সংস্কৃতির এক তরুণ দূত—বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মাঝের কোমল কিন্তু দৃঢ় সেতুবন্ধন।

ইশিকার প্রদর্শনী আমাদের মনে করিয়ে দেয়—জাতীয় পরিচয় কোনো বোঝা নয়, বরং উত্তরাধিকার, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যেতে থাকে। তার ছোট হাতে লুকিয়ে আছে এক বিশাল মন—যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে গল্প, ইতিহাস ও স্মৃতির আলো যখন হৃদয়ে বহন করা হয়, তখন একটি শিশুও তার দেশের গৌরবকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে পারে।