ইফতেখার মাহমুদ এক অসমাপ্ত কবিতার নাম । মোশতাক আহমদ
কথকের সাথে পৌষ মাসের গল্প
সেই শৈত্যপ্রবাহের সন্ধ্যায় আমাদের শেষ দেখার দিনটার কথা ভাবি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্লান্তিবিহীন কথার ফুল ফুটিয়ে যাচ্ছে ইফতেখার। পৃথিবীর সবকিছু নিয়েই তার বড়ো মায়া। আর তখন আমাকে পায়ের ভর বহনের জন্যে পালাক্রমে ডান ও বাম পাকে দায়িত্ব দিতে হচ্ছে।
আমার মস্তিষ্ক থেকে এর মাত্র বছর দেড়েক আগেই ছোট ছোট কিছু টিউমার অপসৃত হয়েছে। নতুন একটা জীবনে পাখা মেলে উড়ছি। আর কে জানে, হয়তো তখন ইফতেখারের চিন্তার ঘূর্ণনময় মাথার ভেতরে জন্ম নিচ্ছে ক্ষমাহীন, অচিকিৎস্য টিউমার।
প্রথম দেখা হয়েছিল বইমেলায়- দুজন অচেনা লেখকের পরিচয়ের জন্যে আদর্শ জায়গা। ইফতেখার মাহমুদ সেবারে বইমেলার প্রান্তরে অনুপস্থিত নিয়ে উপস্থিত। ওর লেখা নিয়ে অন্যদের মন্তব্য পড়ে তার সাথে পরিচিত হবার আগ্রহ জন্মেছিল। সম্ভবত মিরাজের মাধ্যমে আলাপ।
মিরাজ আমাকে সেবারে ‘কুমীর মুশতাকে’র সাথেও পরিচয় করিয়ে দেয়। সেই মেলার পুরনো গ্রুপছবিতে ইকরাম কবির ভাইও আছেন। কিন্তু সেদিন অনুপস্থিত, গালিবিয়াৎ, দুষ্টু ক্যাডেটের গল্প কিংবা কুমীর চাষীর ডায়েরি- এর কোনোটাই কিনতে পারি না। এই লেখকেরা নিজের বই নিয়ে আলোচনায় মুখচোরা। তবে সেদিন বেশ কিছু সময় ফাল্গুনী হাওয়ায়, আমোদে হিল্লোলে কেটে যায়।
মেলার পরে ইফতেখারের সাথে কথাবার্তা শুরু হয়। কখনোই ওর সাথে পরিচয়টা খুব গাঢ় হয়নি অবশ্য। সে আমার নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, প্রচ্ছদ, এমনকি কাগজের পাতার রং নিয়ে কথা বলে- খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। বলে, অবসরে অবসরে পড়ছি, ভালো লাগছে পড়তে, শব্দ খেয়াল করে লেখা।
আমি ওর লেখা বই হে দিগ্বিদিক, হে অদৃশ্য পড়ে বললাম, বেশ মজার বই।
—বলেন কী ভাই! আনাড়ির কলম, স্নেহে জায়গা দিয়েন।
—মানুষের চেয়ে অমানুষের গল্পই দেখছি বিচিত্র।
—শুনছি কবির কণ্ঠস্বর।
—তোমার লেখার সাথে আমার কবিতার মিল পাই। গ্রন্থসজ্জাতেও মিল আছে।
কথার বুদ্বুদ ফেসবুকের নীলাভ পর্দায়- মাঝে মাঝে।
বছর দেড়েক পর। আমার ছোট কন্যা আইন নিয়ে পড়তে চায়। আমাদের ত্রিভুবনে কেউ আইন পড়েনি। আইন পড়ার জন্যে বিদেশি শহরের নামখচিত কলেজের নাম দেখে সন্দেহ লাগে। ইউনিভার্সিটিতেই বা আইন পড়লে দোষ কোথায়- এসবের জবাব আমাকে কে দেবে?
ভাগ্যিস মনে পড়ে গিয়েছিল, ইফতেখার তো ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আইন পড়ায়। ফোনে সে আমাকে দীর্ঘ সময় নিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। কয়েক মাস পরে কন্যা ভর্তি হয়ে গেল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সেদিনের আলাপেই ইফতেখারকে বলি, আমার অক্ষরবন্দি জীবন বইটা মেলার বেশ আগেই বেরিয়ে যাচ্ছে। তোমাকে উপহার দিতে চাই। আমার এই বিশেষ বইটা আমি উপহার দিতেই ভালোবেসেছি, যতদিন পর্যাপ্ত কপি হাতে ছিল।
ইফতেখার বলে, মেয়েকে ফ্রেঞ্চ ক্লাস থেকে বাড়ি নিয়ে এসে, বেঙ্গল বইয়ে বসা যেতে পারে।
—আমার মেয়ে ফ্রেঞ্চের ফ্যাকাল্টি, আলিয়ঁসে।
—বলেন কী! দারুণ তো! মনীষা ওখানেই যায়।
—শাশ্বতী বড়দের ক্লাস নেয়, ছোটদেরও।
—মনীষার মা বছর তিনেক শিখেছে।
ঘটনাক্রমে সেদিন আমার ২০২০ সালের জন্মদিনের পরের দিন। জানুয়ারি মাস। ভাবলাম, ইফতেখার আসবে, নির্ঝরও আসুক। মানে, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য- সে একের ভেতর পাঁচ। মেঘচিলে সমানে আমার গদ্য-পদ্য প্রকাশ করে যাচ্ছে মাহফুজ। তাকেও আসতে বললাম।
এলো আমার সবগুলো বই 'সেই বই' নামের অ্যাপে পিডিএফ কপি পড়ার দিগন্ত খুলে দেয়া গল্পকার অঞ্জন আচার্য। বের হবো, এমন সময় দুই প্রবাসী সাহিত্যামোদী ছোটভাই ইমতিয়াজ কায়েস রিশা আর মতিন ফোন করে জানালো, ওরা দেশে এসেছে। বেশ কয়েক কপি অক্ষরবন্দি লাগবে ওদের। বাসায় আসতে চায়। আমি ওদেরকে আমার গন্তব্যের কথা জানাই।
সবাই হৈ হৈ করে বেঙ্গলে এসে জুটলাম, তারপর পাশের একটা কফিশপে। মহাসম্মেলন বলা যায়! সেদিনই মুগ্ধকর এই কথকটির সম্যক পরিচয় পাই- দেরিতে হলেও না জানার চাইতে হাজার গুণে ভালো। লক্ষ করলাম, ওর কথাগুলো কেমন যেন স্পাইরাল, অনেকটা জলের ঘূর্ণনের মতো। মনে হয়, আশেপাশে কেউ না থাকলেও সে ‘জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা’ কইতে পারে।
ইফতেখারের হাতে বইটা তুলে দিতেই ও বললো, আমি তো আনিনি কিছু। আমি অবশ্য কাউকে নিজের বই দিইও না। তারপর তার এই কথাটাকে প্রতিষ্ঠা করলো দীর্ঘ একটা অনুচ্ছেদে। আমরা সবাই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ওর কথা গিলতে থাকি।
বছর দুয়েক পরে আবার একটা আইনি পরামর্শের জন্যে ইফতেখারকে ডাকি। সেদিন জানলাম, মাঝে মাঝে সে আদালতেও যায়- ওকালতির জন্যে নয় অবশ্য। তবে সেদিন সে মানিকগঞ্জে।
ও ফেরার পর আমি গেলাম চট্টগ্রাম আর কক্সবাজারে, বন্ধুদের পুনর্মিলনীতে। শেষে আবারও সেই জানুয়ারি, ২০২৩। জন্মদিন পার হয়েছে দু’তিন দিন আগে। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সেই ধানমন্ডী সাতাশ নম্বরের কফিখানাতেই।
সেবারেও আরও অতিথি ছিল। চলচ্চিত্রের মানুষ আসাদ জামানের সাথে দেখা হবার দিনক্ষণ মেলানো যাচ্ছিল না। তাকেও আসতে বললাম। আমি সিনেমার কি বুঝি! অগত্যা সঙ্গী হিসেবে সেই একের ভেতর পাঁচ।
ইফতেখারের সাথে কাজের কথাগুলো সেরে ফেলার পর ওরা আসে। সেদিন ইফতেখার খুব লাজুকভাবে ওর একটা বই আমাকে দিয়ে বললো, কাউকে নিজের বই দেয়ার মধ্যে যে জড়তা থাকা উচিত নয়, এটা অনুচিত কোনো কাজও নয়- সেটা আপনাকে দেখে মেনে নিয়েছি। এই বইটা আপনার জন্যে।
বইয়ের নাম অসমাপ্ত সাঁকো। প্রচ্ছদে এবারেও সব্যসাচী হাজরার হাতের বর্ণবিন্যাস। প্রচ্ছদে ছবির চাইতে ক্যালিগ্রাফি নিশ্চয়ই তার নিজেরও পছন্দের। বইয়ের পাতায় আমার অনুরোধে একটা অটোগ্রাফ দিয়েছিল—
আমরা কফিপান শেষে বাইরে গিয়ে পিঁয়াজু, ডালপুরি ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করলাম। কেউ একজন একটা সিগারেট ধরাতেই ইফতেখার সিগারেটকে কেন্দ্র করে নিজের প্রায় ধ্বংস হতে বসা আগের জীবনের কথা বললো।
তারপর সে রাতেই এই নিয়ে তার লেখাটার (সিগারেট, কথা আর গল্পের জীবন, ২০১৭) পিডিএফ পাঠালো। পড়ে দেখলাম, কন্যার শিশুসুলভ প্রশ্নগুলোকে সে কত গুরুত্ব দিতো, সেসব নিয়ে ভাবতো, হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করতো।
ইফতেখার বরাবরের মতো ঝরঝরে গদ্যে লিখেছে- সিগারেট হচ্ছে জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বী। সুন্দর সময়গুলো কেড়ে নেয়। নিঃসঙ্গতা দূর করার সঙ্গী নয়, বরং মানুষের জন্যে কাম্য ও মূল্যবান নিঃসঙ্গতাকেই সে হরণ করে।
সেদিন শীতে কাঁপতে কাঁপতে আবারও ইফতেখারই আড্ডার মধ্যমণি। প্রতিটা প্রসঙ্গ নিয়েই তার নিজের মতো করে বলবার কিছু কথা আছে।
কয়েকদিন পর তিনটা গল্প পড়া হলে ওকে জানাই কেমন লাগলো। আগের লেখাগুলো পড়ে মনে হয়েছিল লেখাগুলোতে প্রতিভার দ্যুতি ছড়ানো আছে, এবারে মনে হলো পূর্ণাঙ্গ ও পরিণত গল্পের ঝুলি।
—অসমাপ্ত গল্পের প্রধান চরিত্রের নাম শাহাদুজ্জামান। ইন্টারেস্টিং! রহস্য কি? আমার বেশি পছন্দ হয়েছে গল্প প্রতিযোগিতায় বিচারকের গল্পটা। এটা জানাতেই বার্তাটা পাঠালাম।
—শাহদুজ্জামান নামের একজনকে নিয়ে কয়েক পর্বের এক লম্বা গল্প লিখেছিলাম। একজনেরই কয়েকটা নাম দরকার ছিল—শাহাদ, শাহাদুজ্জামান, শাদু, জামান। বাকি পর্বগুলো আমার কাছে রয়ে গেছে।
এই গল্পটা বাবা আর মেয়ের সম্পর্কের গল্প। ইফতেখারের অনেক গল্পই বাবা আর মেয়ের রসায়ন নিয়ে লেখা। মেয়েটা ছিল ওর জীবন।
আমার গিন্নির সাথে প্রাতঃভ্রমণের সময় কখনো দেখা হয়ে যেত সস্ত্রীক ইফতেখারের। প্রথম দিন সে-ই চিনতে পেরে এগিয়ে এসে বলেছিল, আপনি মোশতাক ভাবি? আমি মনীষার বাবা।
মনীষা তার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে চুরি গল্পটা পড়তে দিয়েছে। গল্পটা মেয়ের মনমতো হয়নি। মেয়ে বলেছে, লেখক হতে হলে খুব কল্পনাশক্তি লাগে।
ইফতেখার লিখেছে, মেয়ের চোখেমুখে বাবার অপারগতার জন্য সহানুভূতি। হেসে উঠতে গিয়ে মনটা মায়ায় আর্দ্র হয়ে উঠলো।
অসমাপ্ত সাঁকো অনিত্যের মধ্যে চিরন্তনের গল্প নিয়ে এক অপূর্ণাঙ্গ আয়োজন।
ইফতেখার মাহমুদ এক অসমাপ্ত কবিতার নাম।
ঢাকা, ৩১ অক্টোবর ২০২৫।
মোশতাক আহমদ : কবি, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক। বসবাস- ঢাকা, বাংলাদেশ । প্রকাশিত গ্রন্থ- মেঘপুরাণ; ঝিনুক নীরবে সহো; ভেবেছিলাম চড়ুইভাতি; যাই ভেসে দূর দেশে; অক্ষরবন্দি জীবন; বুকপকেটে পাথরকুচি; নারসিসাসের আরশি; ডুবোজাহাজের ডানা প্রভৃতি।




