কিযী’র গল্পের ভুবন: বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে । আতিকুর রহমান শুভ

আমার বহুদিনের পুরনো অভ্যাস ঘুম থেকে উঠে টাইমলাইন চেক করা কিংবা দেশ-বিদেশের খবরে চোখ বুলানো। গত কয়েকদিনে এর ব্যত্যয় হয়েছে। আমার দুই পাশে কিযী তাহনিনের দুটি বই। বিছানা ছাড়ার আগে আরও একটি গল্প পড়া হয়ে যাচ্ছে। এবেলা পড়ছি একটা, ওবেলা আরেকটা— বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে কিংবা আছে এবং নাই।
এই বই আবার গোগ্রাসে যেমন করে উপন্যাস পড়া হয়, সেভাবে পড়া যাবে না। কিযীর প্রত্যেক শব্দ, বাক্য পড়তে হয়। এমনকি যতিচিহ্ন কোথায় থেমেছে, তাও খেয়াল করতে হয়।
তাই একেক সময় কেবল একটি গল্পই পড়ে ফেলি। কিংবা আগের রাতে ঘুমানোর আগে যে গল্পটা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, সকালের নির্মল আলোয় আবারও পড়ি। তাতে নতুন অর্থ হয়, হয় নতুন উপলব্ধি।
ধরুন বুধ গ্রহের মধ্যদিনের গান গল্পটিতে শুরুতেই কী চমৎকার দৃশ্যকল্পনা—
“দিনের প্রথম প্রহরের শেষ দিকের নির্বিকার সূর্য, উপস্থিত আছে ঠিকঠাক। মার্চের মাঝামাঝি হঠাৎ কোকিলের ডাক, কোত্থেকে দিন ভাঙার গান হচ্ছে। গাছের পাতার মৃদু দুলুনি, তার চেয়েও মৃদু লয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী।”
আর কী সহজ সরল স্বীকারোক্তি কিযীর—
“আমি শহরটাকে যেরকম করে দেখতে চাই, শহরটা আসলে সেরকমই। আমি যে সময়ে দেখতে চাই, শহরটা হয়তো সে সময়ের।”
আমাদের স্কুলে ব্যাকরণ পড়াতেন নরেন স্যার। কারক ও সমাস বুঝাতে স্যার পড়িয়েছিলেন— নগরের নটী চলে অভিসারে, যৌবন মদে মত্তা।
বেশ কয়েক মাস আগে আজকের গল্পকার তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। সেটি ছিল প্রখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের কাভারে তাঁর এক সাহসী ছবি। ছবিটা দেখেই আমার নরেন স্যারের উক্তির কথা মনে হয়েছিল।
কিন্তু মুশকিল হলো, বিষয়বস্তু মেলেনি, তবু বলতে ইচ্ছে করেছে! তিনি তো নগরের নটী কিংবা বিনোদিনী নন— তিনি তো রীতিমতো টপসেলার গল্পকার এবং পদবীতে ডাকসাইটে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা। বরং আমরা তাঁকে নগরের রাইটার বললেই ভালো হয়— আমাদের আধুনিক রাইটার।
তাঁর ফিওনা ফ্যাশনিস্তা গল্পে আমার সেই ভাবনার পরিপূরণ হলো। এতগুলো গল্প পড়ে স্বয়ং কিযীকেই যেন পাওয়া গেলো ফিওনা ফ্যাশনিস্তার মুখোশ বিলাস গল্পে। ঠিক সারারাত না ঘুমিয়ে অলস সকালে ঘুম থেকে ওঠা কেবল ফিওনাতে ডুব দেওয়া কিযীকে দেখা গেলো।
যখন তিনি ভাবছেন—
“চুলের কতটুকু এলোমেলো, কতটুকু পরিপাটি থাকবে, সব নির্ধারণ করছে শাড়িটির ওপর। আর কোন শাড়ি তা নির্বাচন করি আমার দিনটির গুরুত্ব বুঝে।”
অথবা যখন তাঁর দিনের ব্যস্ততার হিস্ট্রি পড়ি—
“সকালে ইনভেস্টর মিটিং, দুপুরে ওয়ার্কিং লাঞ্চ, বিকেলে পিচ প্রেজেন্টেশন, খুচরো দুটি অফিস মিটিং আর রাতে কাজসংক্রান্ত এক সামাজিক বুদ্ধিহীন পাঁচতারা হোটেলে নিমন্ত্রণের জন্য তৈরি আমি ফিওনা ফ্যাশনিস্তা।”
গল্পের শেষে এও বুঝি, দিনশেষে তিনি ফিরে আসছেন আপন ভূবনে—
“লিফটে আমি একা ফিওনা ফ্যাশনিস্তা, আমার দিনশেষের প্রলেপের মুখোশগুলো একটা একটা করে খুলি।”
এ যেন অভিনেত্রীদের মেকআপ তুলে ফেলার মতো দৃশ্যপট। একেকটা নাটকে একেকটা চরিত্রের ফিওনা, কিংবা গল্পকথক কিযী নিজে।
কিযীর প্রত্যেক গল্পে মানুষ দেখার সাধ মেটে। মেটে বর্ণিল প্রকৃতি দেখার চাহিদাও। বাঙালি চিরকাল সার্কাস দেখতে চায়, কিন্তু তারচেয়েও বেশি চায় মানুষ দেখতে। নানা দেশে নানা রঙের মানুষ দেখতে আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই।
ঠিক সেভাবেই আমি মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট গল্পে আমাদের জন্য সেই বিচিত্র মানুষ দেখার টুইস্টটিই অপেক্ষা করে—
“আমি চিরকুট হাতে অপেক্ষা করি। এক তাড়াহীন বোধ। দুপুর শেষে পথে নামি। হাঁটি। কাজ খুঁজতে হবে। আমি এখন আর মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট নই। আমি এবার কি হব?”
এই বইয়ের শেষ গল্পটি হলো বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে। নগর থেকে কিযী যেন নেমে এসেছেন ব্রহ্মপুত্রের পারে কানিজ ফাতেমা হয়ে।
তিনি বলছেন—
“ময়মনসিংহের এক অতি মধ্যবিত্ত ঘর, যা আকালের দিনে নিম্নবিত্তের পর্যায়ে নেমে এসেছে কখনো। আবার সংগ্রাম করে কষ্টেসৃষ্টে মধ্যবিত্ত হয়ে উঠেছে। এমন এক পরিবারের সন্তান কানিজ, আদরের নাম কান্নি…”
সেও বিশ্বাস করে, বুধ গ্রহের কালো মাটির গায়ে জয়নুলের আঁকা একটি ছবি আছে। যে ছবিটি অপার বিস্ময় নিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার থেকেই দেখতে পায় মেয়েটি।
বইটিতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার গল্পটি বিলম্বি টান। এটি আমি আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম। বইটিতে আবারও পড়লাম।
কলোনির ধারেই বিলম্বি গাছ। সেই গাছের ধারে মাঝে মাঝে দেখা যায় হলুদ ফিতা সাপ আর সবুজ রঙের টিয়া পাখি। তার বড় বোন একটি বিলম্বি ফল বাসায় এনে রেখেছিল, তাতেই কাজ হয়। পাখিটা পোষও মানে।
কিন্তু একদিন চলে যায় পাখিটি। অনেকদিন তার দেখা নেই। সাপটিও আর দেখা যায় না।
কিন্তু হঠাৎ অনেকদিন পরে—
“বিলম্বি গাছের ধারে যে নালা, সেখানে ফিরে এসেছে সেই হলুদ-লাল ফিতা সাপ। কতদিন পর।”
আর তখনই সাপ আর টিয়ার অমোঘ সম্পর্কের বিশ্বাসে গল্পকারের আশা জন্মে— মেয়েটির ভালোবাসা কিংবা ভালোবাসার টিয়াও একদিন ফিরে আসবে। তিনি বলছেন—
“এমন ঘন দুপুরের সূত্র যদি ঠিকঠাক মিলে যায়, তো আর একটু পরই, লাল ফিতা বাঁধা টিয়া পাখিরও এই বিলম্বি গাছের কাছে আবার ফিরে আসার কথা।”
আহা!
বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে— দশটি গল্পের বই। কেবল কয়েকটির পাঠ প্রতিক্রিয়া দিলাম। বাকিগুলো আপনারাই পড়ে নেবেন।
কিযী তাহনিনের জন্ম সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল পরিবারে। তাঁর বাবা টিভি ব্যক্তিত্ব খ. ম. হারূন, মা শিক্ষাবিদ। কিযী দীর্ঘদিন মেলবোর্নে থেকেছেন, পড়াশোনা করেছেন মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে।
প্রশান্তিকা বইঘরের সৌজন্যে প্রায় শত কপি বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে এসেছে অস্ট্রেলিয়ায়। তাঁর অসংখ্য বন্ধু ও পাঠক বইটি সংগ্রহ করেছেন। কিযীর সাথে আমাদের এই মিলন ঘটিয়ে দিয়েছেন প্রিয় সুরঞ্জনা জেনিফার আপা। অশেষ ধন্যবাদ তাঁকে— কিযীকে প্রশান্ত পারের পাঠকদের সাথে পরিচিত করার জন্য। নইলে এই বয়সে আমরা পোক্ত এক গল্পকারকে কোথায় পেতাম?
গল্পের সীমানা পেরিয়ে এখন তাঁর কাছে একটি উপন্যাস পেতে চাই। ব্যাকুল হয়ে পড়বো তাঁর বৃহৎ সেই আখ্যান— সেদিনের অপেক্ষায়।
কিযীর বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে বইটি পাঠক সমাবেশ থেকে প্রকাশিত বছরের বেস্টসেলার। একই প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে তাঁর ইচ্ছের মানচিত্র, আছে এবং নাই ও দেড় নম্বরি। তাঁর পরবর্তী গল্পগ্রন্থ ইতি হেকমালতি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
এই লেখাটি যখন লিখছি, তখনও কিযী তাহনিন উপন্যাসটি লেখেননি। অবশেষে বাতিঘর থেকে আমরা পেয়েছি তাঁর প্রথম উপন্যাস— চনর্কি।
চনর্কিসহ তাঁর সবগুলো বই অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যাচ্ছে প্রশান্তিকা বইঘরে।