ভালোবাসার অন্য নাম মেজবান । ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন

ভালোবাসার অন্য নাম মেজবান । ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন

সিডনির ফেয়ারফিল্ড শো গ্রাউন্ডে আগামী ৯ নভেম্বর, রোববার আবারও বসছে সিডনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতির প্রাণের আয়োজন—চট্টগ্রাম উৎসব। প্রবাসে থেকেও চট্টগ্রামের মানুষ যেন একদিনের জন্য ফিরে যান তাদের মাটি, গন্ধ আর স্মৃতির শহরে।

এইবারের উৎসবের এক বিশেষ আকর্ষণ—চট্টগ্রামের মেজবান রান্নার সেলিব্রিটি রন্ধনশিল্পী বাবুর্চি হাজী আবুল হোসেন। যিনি এখন পর্যন্ত সহস্রাধিক মেজবানি রান্না করেছেন, যা এক অনন্য ইতিহাস! আয়োজকদের আন্তরিক আমন্ত্রণে তিনি এবার পাড়ি দিচ্ছেন প্রশান্ত মহাসাগরের ওপার থেকে, ঠিক চট্টগ্রামের রঙ, ঘ্রাণ আর স্বাদের বার্তা নিয়ে।

খোদ শো গ্রাউন্ডের কিচেনেই হবে আসল মেজবানি রান্না। সেই ঐতিহ্যবাহী মেজবানি চাল, ঝরঝরে মাংস আর মসলার মায়া—আবুল বাবুর্চির হাতের জাদুতে সেই খাবারের স্বাদ হবে অমৃত, আর তার সুবাসে যেন কিছুক্ষণের জন্য সিডনি হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম।

এবারের আয়োজনের সাংস্কৃতিক পর্বের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ—বাংলা সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তি শিল্পী, চট্টগ্রামের গর্ব নকীব খান। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁর সৃষ্টি, সুর আর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তিনি উপহার দিয়েছেন অগণিত কালজয়ী ও সুপারহিট গান, যা আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে একই রকম অনুরণন তোলে।

বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতে রক ধারার সঙ্গে মেলোডির অনন্য মিশেলে নকীব খান তৈরি করেছেন এক স্বতন্ত্র সুরভুবন, যা বাংলা গানের ইতিহাসে চিরকাল বিশেষ হয়ে থাকবে। এবার চট্টগ্রাম উৎসবের মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি হবে এক স্মরণীয় মুহূর্ত, যেখানে নস্টালজিয়া আর সুরের জাদু মিলেমিশে যাবে একাকার।

সিডনির মেজবান উৎসবের গল্পটা যেন এক টুকরো চট্টগ্রামকে তুলে এনেছে বিদেশের আকাশের নিচে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন প্রথমবার মেজবানের ধোঁয়া উঠেছিল সিডনির আকাশে, তখন আমরা ক’জন চাটগাঁইয়া মিলে শুরু করেছিলাম এই যাত্রা। সেই দলের একজন ছিলাম আমিও।

আমার সিডনিতে পা রাখা ১৯৮৮ সালে। তখন শহরে বাংলাদেশিদের সংখ্যা গোনা যেত হাতে। চট্টগ্রামের কাউকে খুঁজে পাওয়া ছিল যেন মরুভূমিতে মরুদ্যান দেখা। ধীরে ধীরে দেখা মিলল কিছু চেনা মুখ, কয়েকজন চাটগাঁইয়া ভাই-বান্ধব। একবার পরিচয় হলেই যেন আপন হয়ে যেত সবাই। কথায় কথায় ভেসে আসত চাটগাঁইয়া আঞ্চলিক ভাষার সুর, যেটা নিয়ে অনেকেই খুনসুটি করত, কিন্তু আসলে সেটাই তো আমাদের টান—কর্ণফুলীর জলের মতো গভীর মায়ার টান।

প্রথম মেজবান হয় ১৯৯৪ সালে, সিডনির শান্ত, মনোরম ডলস্ পয়েন্টে। কোনো বিশাল আয়োজন ছিল না—ডজনখানেক পরিবার আর কিছু তরুণ মিলে সাজানো এক নিখাদ আনন্দঘন দিন। সেই ছোট্ট আয়োজনই ধীরে ধীরে পরিণত হয় সিডনির অন্যতম জনপ্রিয় প্রবাসী উৎসবে। কখনো এক বছর, কখনো দুই বছর পরপর মেজবান অনুষ্ঠিত হতে থাকে, আর প্রতিবারই বেড়েছে মানুষের ভালোবাসা, অংশগ্রহণ আর চট্টগ্রামের গর্ব।

২০১৮ সালের মেজবান সেই ধারাবাহিকতার এক রেকর্ড সৃষ্টি করে—প্রায় তিন থেকে চার হাজার মানুষের মিলনমেলা! আর পরের বছর, ২০১৯-এ আয়োজনকে আরও ঐতিহ্যবাহী করতে চট্টগ্রাম থেকে বিশেষভাবে আনা হয় বিখ্যাত বাবুর্চি হাজী আবুল হোসেনকে, যার হাতের রান্না চট্টগ্রামের গন্ধ আর স্বাদ এনে দিয়েছিল সিডনির বাতাসে।

“মেজবান” বা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণে “মেজ্জান”—এ শুধু একবেলা খাওয়ার আয়োজন নয়, এটি চট্টগ্রামের আতিথেয়তার প্রাণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলা এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।

ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা থেকেই মেজবানের সূচনা। যেমন আকিকা, খৎনা, কিংবা কেউ মারা গেলে মৃত্যুর চতুর্থ দিনে “চাইদিন্নে” আর চল্লিশতম দিনে “চল্লিশার মেজবান”—এসব আয়োজনে চট্টগ্রামের ঘরে ঘরে ধোঁয়া ওঠে গরুর মাংসের হাঁড়িতে। সামর্থ্যবান পরিবারগুলো প্রতিবছর প্রিয়জনের মৃত্যুবার্ষিকীতেও এই ঐতিহ্য রক্ষা করে। অনেক সময় আবার কোনো পীরের জন্মদিন বা ওফাত দিবসেও মেজবানের আয়োজন হয়।

তবে সময়ের সাথে মেজবান ধর্মীয় গণ্ডি পেরিয়ে এখন পরিণত হয়েছে আনন্দ, বন্ধুত্ব আর সামাজিক বন্ধনের উৎসবে। এখন আর কোনো নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। চট্টগ্রামের মানুষ অজুহাত পেলেই মেজবান সাজায়—বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদের সাথে, কোনো সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে, কিংবা শুধু আনন্দ ভাগ করে নিতেই আয়োজন করা হয় মেজবান।

এই সংস্কৃতির সৌন্দর্য এখানেই—বিত্তশালী থেকে নিম্নবিত্ত, সবাই নিজের সাধ্য মতো মেজবানের আয়োজন করে। অনেকে আবার ধার-দেনা করেও পারিবারিক ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখেন। ধনীদের মধ্যে একপ্রকার মৃদু প্রতিযোগিতাও চলে, কার মেজবানে কত গরু জবাই হলো! সাম্প্রতিক সময়ে মহিষের মাংস দিয়েও মেজবানের রান্না হচ্ছে, আর সেটি ভোজনরসিকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মেজবান খেতে আমন্ত্রণ লাগে না। কেউ বলল, “ওমুকের বাড়িতে আজ মেজবান”—এইটুকুই যথেষ্ট। সবাই জানে, দরজা খোলা, হাঁড়ি ফুটছে, আর জায়গা আছে সবার জন্য। চট্টগ্রামে মেজবানের কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম নেই, সারাবছরই কোথাও না কোথাও মেজবান চলছে।

খাওয়ার রীতিটাও আলাদা। মানুষ মাটিতে মুখোমুখি বসে একসাথে খায়, পাত্রে পাত্রে ভাগাভাগি করে নেয় সুখ আর তৃপ্তি। যদিও এখানে একটা শ্রেণিভেদও দেখা যায়—গণ্যমান্যদের জন্য থাকে টেবিল, আর সাধারণ মানুষ খায় মাটিতে বসে। এ নিয়েও চট্টগ্রামের লোকসংগীতে আছে রসিকতা আর কৌতুক, যা এই উৎসবকে আরও জীবন্ত করে তুলেছে।

মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়ে ঐতারত (ওই বাসায় চলছে মেজবান)

গরীবুল্যাই মেইট্যা  বছি (গরীবের জন্য মাটির বাটি)

ডঁর মাইনসুল্যাই বাসনত (বড়লোকদের জন্য বাসন)

কি সোন্দইয্যা বিছানত (কি সুন্দর বিছানায়)

মেজ্জান দিয়ে মেজ্জান দিয়ে ঐতারত।

সাদা ভাত এবং গরুর মাংসের বাহারী পরিবেশনায় গণভোজের নাম হলো মেজবান। তবে সাথে গরুর মাংসের হাঁড়-গোড় ও নেহারি (চট্টগ্রামের ভাষায় নলা) দিয়ে ডাল ও সবজির কয়েকটি পদও পরিবেশন করা হয় মেজবানে।

চট্টগ্রামবাসীর কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার বলতে যদি কিছু থাকে, তার শীর্ষে থাকবে মেজবানের খাবার। এই খাবারের প্রতি চাটগাঁইয়াদের টান যেন রক্তে মিশে আছে, যা অন্য অঞ্চলের মানুষের কাছে অনেক সময় বোঝা কঠিন। মজার ব্যাপার হলো—কেউ যদি মেজবানের নিমন্ত্রণ পান, তবে পাঁচতারা হোটেলের পার্টি, অভিজাত কমিউনিটি সেন্টারের বিয়ে বা শত পদে সাজানো ভোজ—সবকিছুই তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়।

এটাই চট্টগ্রামের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য—যেখানে খাবার মানেই মিলন, আর মিলন মানেই মেজবান।

দেশের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর যেখানে যেখানে চট্টগ্রামের মানুষ আছে, সেখানেই চলছে মেজবানের ধোঁয়া ওঠা হাঁড়ি। বিশেষ মশলার মিশ্রণ আর প্রচুর কাঁচামরিচে তৈরি এই খাবারের স্বাদ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের মানুষও এখন মেজবানের মাংসের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।

প্রবাসেও এর জনপ্রিয়তা বিস্ময়কর। লন্ডন, দুবাই, কাতার, নিউ ইয়র্ক—সব জায়গার বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোতে ‘মেজবানি মাংস’ এখন নিয়মিত আকর্ষণ। আর সিডনির কথা আলাদা করে না বললেই নয়—সেখানে তো রয়েছে পুরোপুরি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যকে ঘিরে গড়া রেস্টুরেন্ট, যার নামই ‘মেজবানি’।

আজ সিডনির মেজবান শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটা এক সেতুবন্ধন—চট্টগ্রামের স্মৃতি, মাটির গন্ধ আর প্রবাসজীবনের মাঝেও না ভোলা এক টান। বৃহত্তর চট্টগ্রাম সমিতি আয়োজিত চট্টগ্রাম উৎসবের মেজবানে আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ রইল।

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন: লেখক, গীতিকার, কন্ঠশিল্পী ও প্রকৌশলী। বর্তমানে তিনি সিডনি, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- খুঁজে পেয়েছি প্রিয়তমা, কাতারে জীবন যেমন, ভাবনার দিগন্তে এবং কাতারে বহতা জীবন।