ফরিদা পারভীনের জীবনাবসান

গতকাল শনিবার রাত সোয়া ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তিনি স্বামী এবং চার সন্তান রেখে গেছেন।
কিংবদন্তি শিল্পীর মৃত্যুর খবরে প্রথমেই মনে পড়ছে তাঁর কণ্ঠে গাওয়া লালনের এই গান—
“আমি অপার হয়ে বসে আছি/ ও হে দয়াময়/ পাড়ে লয়ে যাও আমায়….”
মরমী কণ্ঠশিল্পী লালন সাধক ফরিদা পারভীন। মূলত পল্লীগীতি গেয়ে থাকলেও বিশেষ করে তিনি লালনসঙ্গীতের জন্য বেশি জনপ্রিয়। জন্ম নাটোরে হলেও বড় হয়েছেন কুষ্টিয়ায়। ১৯৬৮ সালে তিনি রাজশাহী বেতারে নজরুল সঙ্গীতের জন্য নির্বাচিত হন। নজরুলগীতি দিয়ে শিল্পীজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের দিকে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঔল গ্রামে। শাঔল বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রাম কলমের একটি অংশ। বাবা প্রয়াত দেলোয়ার হোসেন ছিলেন চিকিৎসক। মা রৌফা বেগম। ফরিদা পারভীনের স্বামী প্রখ্যাত গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পী আবু জাফর। সংসারে চার সন্তান রেখে অধ্যাপক আবু জাফরের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ হয়। এরপর তিনি বিখ্যাত বংশীবাদক আব্দুল হাকিমকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন।
শিক্ষা ও সংগীতজীবনের সূচনা
মাগুরায় স্কুলজীবনের সূচনা হলেও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা কেটেছে বিভিন্ন শহরে। তিনি কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল, কুষ্টিয়ার মীর মোশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় এবং মেহেরপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করেন। কুষ্টিয়ার মীর মোশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি এবং কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৬-৭৯ সালে অনার্স সম্পন্ন করেন।
গানের হাতেখড়ি হয় মাগুরায়, ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। পরে কুষ্টিয়ার ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস ও ওসমান গণির কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখেন। প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরা নিয়ে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চার পর নজরুলগীতি শেখা শুরু করেন। তাঁর নজরুল সঙ্গীতের প্রথম গুরু ছিলেন কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদের। এরপর মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলীর কাছেও তালিম নেন। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁর লালন সঙ্গীতের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ঘটে। কুষ্টিয়াতে পারিবারিক বন্ধু গুরু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছ থেকে তিনি ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শেখার মাধ্যমে লালন সঙ্গীতের তালিম নেন। পরে খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই ও করিম সাঁইয়ের কাছ থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৭৬ সালে তিনি বেতার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৮৭ সালে একুশে পদক এবং ১৯৯৩ সালে ‘আন্ধো প্রেম’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
ফরিদা পারভীন শুধু লালনের গানই নয়, সমান দক্ষতায় গেয়েছেন আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান। তাঁর কণ্ঠের জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে—
- “এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে”
- “তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম”
- “নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বলো”
- “খাঁচার ভিতর”
- “বাড়ির কাছে আরশিনগর”
অ্যালবামসমূহ
- ১৯৭৬ : অচিন পাখি (লংপ্লে রেকর্ড, স্পন্সর: শ্রোতার আসর – বর্তমান ACI কোম্পানি)
- ডন কোম্পানি : লালনগীতি
- সারগাম : লালনের গান
- দোয়েল প্রোডাক্টস : দেশাত্মবোধক, আধুনিক ও লালনের সমন্বিত ক্যাসেট
- আরশিনগর ব্যানার : আমারে কি রাখবেন গুরু চরণে
- বেঙ্গল ফাউন্ডেশন : সময় গেলে সাধন হবে না
- আবুল উলাইয়ার পরিবেশনায় : আশা পূর্ণ হলো না, লাইভ কনসার্ট ইন জাপান
- তোমার মতো দয়াল বন্ধু আর পাবো না
- সমুদ্রের কূলেতে বসে
অবদান ও সম্মাননা
ফরিদা পারভীন ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে লালন সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মঞ্চে তিনি গান পরিবেশন করেছেন এবং ভক্তদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।
তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমি স্বর্ণপদক, বেতার শ্রেষ্ঠ নজরুল সঙ্গীত শিল্পীসহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
রাশেদ রেহমান : সম্পাদক, ক্যাপ্টেন; ঔপন্যাসিক। বাংলাদেশ।