উৎসব- আমাদের নিজস্ব সিনেমা । তানজিনা ফেরদৌস তাইসিন

উৎসব- আমাদের নিজস্ব সিনেমা । তানজিনা ফেরদৌস তাইসিন
উৎসব পোস্টার। ছবি- চরকি।

'বাংলা সিনেমার সুদিন’ বহুল প্রচলিত এবং বহুলচর্চিত এই শব্দবন্ধ-টি দু’দিন পর পর শোনা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে। সিনেমাটোগ্রাফিকালারগ্রেডিংআর্ট ডিরেকশন কিংবা পোশাক সবেতেই একটা ঝা-চকচকেউন্নতি সাধিত হয়েছে–  এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তুদক্ষিণীসিনেমার আদলে মারামারিখুনোখুনিগ্যাংস্টার নায়ক কিংবামিসোজিনির গল্প দিয়ে বাংলা সিনেমার সুদিন ফেরেনা। 

ব্যাড বয়” নায়কের চরিত্রায়নেও মনে হতে থাকে এ তো আমাদের দেশিকেউ নাদক্ষিণি সিনেমার বিদ্রোহী নায়ক যার মারামারিখুনোখুনিরধরনও এদেশীয় নয়। নারী চরিত্রের চিত্রায়নে থাকে প্রচ্ছন্ন অথবা প্রকটনারী বিদ্বেষ। কখনো সে নারী লোভী হয়ে পুরুষ সঙ্গীকে দিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করিয়ে নিচ্ছেনয়তো ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে একপ্রেমিক-কে দিয়ে আরেক প্রেমিক-কে খুন করিয়ে নিচ্ছে। সত্য ঘটনার অবলম্বনের মোড়কে নির্মিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব টুইস্টেড নারী বিদ্বেষী গল্প। চকচকে ঝকঝকে নির্মাণে আমরা বাংলা সিনেমার সুদিন ফেরার আশায়হলে গিয়ে দেখে আসছি যে সব গল্প তা কোনও মতেইআমাদের নিজস্ব সিনেমা না। 

স্বকীয়তা তৈরি করা না গেলে সিনেমার নিজস্ব ভাষা তৈরি হয়না। এর ভেতর যে কিছু ভালো কাজ হচ্ছে না তা বলা ঠিক হবে না। সিনেমার নিজস্ব ভাষা তৈরির প্রচেষ্টায় নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনো চলমানতার ভেতর বেশ কিছু সৎ প্রচেষ্টাও বিগত বছর গুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে।  

এবার আসি ‘উৎসব’ প্রসঙ্গে। 

সম্প্রতি অ্যাডিলেইডে হয়ে গেল ‘উৎসব’ সিনেমার দুটি হাউজফুল শো। অ্যাডিলেইডে নতুন প্রতিষ্ঠান কোয়াজার সোনোমাটোগ্রামের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘লাইট ক্যামেরা একশন'র আয়োজনে এবং সার্বিকভাবে অস্ট্রেলিয়ার সিনেমাটি পরিবেশন করছে পথ প্রোডাকশন। যে সময়টাকে বাংলা সিনেমার সুদিন বলা যায়অর্থাৎ যখন দর্শক হলমুখী ছিলসে সোনালি সময়ে নির্মিত হয়েছিল 'জীবন থেকে নেয়া' 'আবার তোরা মানুষ হ' 'পদ্মা নদীর মাঝি'র মত দুর্দান্ত সব সিনেমাসে সময়টার গল্প যেমন শুনেছি মা-খালাদের কাছেসবাই মিলে উৎসব করে সিনেমা দেখতে যেতো সিনেমা হলে। ঠিক তারই একটা প্রতিচ্ছবি যেনো দেখা গেল  উৎসবের স্ক্রিনিংয়ে। হল ভর্তি মানুষ এসেছে পরিবার-সহ। গল্পকরছেহাসছেছবি তুলছেসোশ্যালাইজেশন করছেসিনেমা দেখার উসিলায় যেন প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে নিচ্ছে। সিনেমার ট্যাগলাইনও ছিল"পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ"। পর্যাপ্ত প্রচার প্রচারণা ছাড়াও যে একটাভালো এবং সৎ সিনেমা মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারে এবং মুখেমুখেই ছড়িয়ে যেতে পারে এর সুখ্যাতিতার বিরল এবং চমৎকার উদাহরণ হল 'উৎসব'। 

অবাক করা ব্যাপার হলঅ্যাডিলেইডের মত শহর গুলোতেযেখানে বাঙালির‍ বসত সীমিত যেখানে গড়পড়তা একেকটা সিনেমার একটা শোই হাউজফুল হয় না প্রায়শঃ সেখানে উৎসব সিনেমার তৃতীয় শো আয়োজিত হতে যাচ্ছে এবং আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলসিনেমারটিকেট সব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছেআশা করা যাচ্ছে এই সিনেমা এবারো হাউজফুল হবে। এবারের এই সিনেমার আয়োজন করছে অ্যাডিলেইডে এন্টারটেইনমেন্ট জগতের পুরনো নাম গ্লোবাল অস্ট্রেলিয়া মিডিয়া এন্ডএন্টারটেইনমেন্ট (গেম)। এবারের আয়োজন হতে যাচ্ছে একটি মহতী উদ্দেশ‍্য সামনে রেখে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নাজিউল খান বীর জানিয়েছেনএই শো থেকে প্রাপ্ত প্রতিটি অর্থ ব্যয় করা হবে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মাইলস্টোন ট্রাজেডির ভিকটিমদের সাপোর্টের উদ্দেশ্যে। 

কি আছে এই সিনেমায়কি এমন জাদুযেখানে দর্শক হুমড়ি খেয়েপড়ছে হলেএমনকি অ্যাডিলেইডের মত ছোট্ট বাঙ্গালি বসতির শহরেওতৃতীয় হাউজফুল শো-এর পর চতুর্থ শোএর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পরিচালক তানিম নুর তার মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন গল্প নির্বাচনেরক্ষেত্রে। সেই একি 'ব্যাড বয়স্টোরি। কিন্তু সেই ব্যাড বয় প্রোটাগনিস্টজাহাঙ্গীর চাচা আমাদের নেক্সট ডোর নেইবর। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়াআমরা এমন একজন হাড়  কিপটেখিটখিটে মাঝবয়সী  ভদ্রলোকদেখতে পাইযে ঠিক খারাপ মানুষও নাআবার প্রব্লেমেটিকতারচরিত্রের ক্ষুদ্রতার কারণে নিঃসঙ্গ হয়ে পরা একজন মানুষ–  যে কিনা তারমানসিক সীমাবদ্ধতার অনুধাবন কখনো করতে পারেনিকেবলহারিয়েছে সব। এই মানুষটার গল্প যে সুনিপুণ দক্ষতায় পরিচালকবলেছেন সেটিই এই সিনেমার বড় শক্তি। 

লক্ষ করে দেখবেনএই সিনেমাও কিন্তু মৌলিক গল্প নয়। 

চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত গল্প "আ ক্রিসমাস ক্যারল"-এর অনুপ্রেরণায় লেখা গল্প। কিন্তু সেই গল্প-কে একদম আমাদের দেশীয় গল্প বানিয়েফেলার কৃতিত্ব পুরো টিমের। 

চিত্র্যনাট্যকারের মুনশিয়ানার কথা আলাদা করে না বললে অন্যায় হবে। তরুণ চিত্র্যনাট্যকার আয়মান আসিব স্বাধীনের সাথে আমার পরিচয়ঘটে "কাইজারদেখার মাধ্যমে। নস্টালজিয়া আর বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধের এমন মেলবন্ধন বিরল। স্বাধীন যেমন কাইজারে তিন গোয়েন্দাররেফারেন্সের মাধ্যমে আমাদের নস্টালজিক করে তুলেছিলেন একি ভাবেউৎসবেও আমরা দেখতে পাই,  সেই সময়ের ভিডিও দোকানমধ্যবিত্তমফস্বলের প্রথম কেনা রঙিন টিভিক্যামিও প্রেজেন্সে নানা তারকারস্যটায়ারসেলফ রোস্টিংসাথে গভীর মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণকিংবা নারীরনিজস্ব সংগ্রামের গল্পএকবারেই বাংলাদেশের গল্প দেখতে দেখতে বারবার চমকৃত হচ্ছিলামএমন অনাড়ম্বরসাবলীল ভাবেও গল্প বলতেপারে কেউ বাংলায়এত উচ্চমার্গীয় সেন্স অফ হিউমার সমেত

সিনেমাটগ্রাফার রাশেদ জামানের কথা নতুন করে বলার না থাকলে আলাদা করে এই সিনেমার জন্য অবশ্যই বলতে হবে। তিনি বরাবরের মতই দুর্দান্ত। এত চমৎকার দৃশ্যধারণনা দেখেও বলে দেয়া যায়পেছনে আছেন রাশেদ জামানের অভিজ্ঞ এবং নান্দনিক চোখ। ৯০ এর দশক আর বর্তমানের কালার গ্রেডিং আর লাইটিং খুব সযত্নে আলাদা করা যাচ্ছিল সম্পাদনা আর দৃশ্যধারণের দক্ষতায়। 

জাহিদ হাসান থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি চরিত্র অসাধারণ। এমনঅসাধারণ কাস্টিং-এর পাশাপাশি আমি আরও যে কারণে পরিচালককে সাধুবাদ জানাতে চাই তা হলএত এত তারকার ভিড়ে কেউ কাউকে ম্লান করতে পারেনিপ্রত্যেকেই সমান গুরুত্ব পেয়েছেন

সর্বশেষে অবশ্যই এমন সুন্দর একটা টিমএবং শান্তনরমস্মৃতিকাতরনস্টালজিক অথচ সফেস্টিকেটেড একটা সিনেমা উপহার দেয়ার কৃতিত্ব সিনেমাটির প্রযোজক কৃষ্ণেন্দু চট্ট্যোপাধ্যয় এবং ডোপ প্রোডাকশনের

বাংলা সিনেমার সুদিনফিরিয়ে আনার জন্য এটি একটি মাস্ট ওয়াচ সিনেমাকেউ এখনো না দেখে থাকলে অবশ্যই দেখে ফেলবেন। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো এমন আরও সব সাবলীল মাস্টারপিস, আমাদের নিজস্ব সিনেমা দেখার জন্য। 

তানজিনা ফেরদৌস তাইসিন : লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। প্রশান্তিকা প্রধান, এডেলেইড। 
বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ায় একশন এইড, ওয়েস্টপ্যাক সহ নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে ফ্লিন্ডার্স ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত।