বঙ্গবন্ধু: প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অগ্নিশিখা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি । শাখাওয়াৎ নয়ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অমর প্রতীক, মানবতা ও ন্যায়বিচারের অবিচল কণ্ঠস্বর; ত্যাগ, সাহস আর ভালোবাসার মহাকাব্যিক সংমিশ্রণ। ১৭ মার্চ ১৯২০-এর টুঙ্গিপাড়ার ভোর যেন জন্ম দিয়েছিল এক অনন্য সত্তাকে- যিনি আজও বাঙালির হৃদয়ে জ্বলে ওঠেন স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হয়ে।
তিনি ছিলেন সেই নেতা, যিনি শোষিতের পাশে দাঁড়াতেন পর্বতের মতো দৃঢ় হয়ে, আর ভালোবাসায় ভিজিয়ে দিতেন শুষ্কতম হৃদয়ও। তাঁর আজীবনের প্রয়াস ছিল এক বিভক্ত জাতিকে সমতা, ন্যায় ও স্বপ্নের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করা। উপনিবেশিক শাসনের শেকল, বৈষম্যের অন্ধকার আর অবহেলার দীর্ঘ ছায়াকে ছিন্ন করে তিনি বুনেছিলেন স্বাধীনতার রঙিন আকাশ।
ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে, ছয় দফার দাবিতে জাগ্রত আন্দোলনে, ৭ মার্চের অগ্নিঝরা উচ্চারণে- তাঁর প্রতিটি শব্দ ছিল বজ্রের মতো দৃপ্ত, আবার পিতার মতো মমতাময়। সেই দিনে তিনি ঘোষণা করেছিলেন-
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
কারাগারের অন্ধকূপ তাঁর মনোবল ভাঙতে পারেনি; বরং বন্দিদশার অন্ধকারে তিনি শাণিত করেছিলেন স্বাধীনতার দীপ্ত তলোয়ার। পাকিস্তানি শাসকের শোষণযন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদার যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রি তাঁকে শারীরিকভাবে বন্দি করেছিল, কিন্তু তাঁর স্বপ্নকে নয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যখন বাংলার আকাশ ছুঁয়েছিল, তখন ফিরে এসে তিনি দাঁড়ালেন ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা এক নবজাত দেশের কর্ণধার হয়ে। যুদ্ধের ক্ষতবিক্ষত মাটি জুড়ে তিনি বুনেছিলেন পুনর্গঠনের বীজ—শিক্ষা, কৃষি, শিল্প আর ঐক্যের বীজ। তিনি তখনও জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিতেন-
“আমি জনগণকে ভালোবাসি, জনগণই আমার শক্তি।”
তিনি ছিলেন ক্ষমার এক দুর্লভ উদাহরণ। যুদ্ধের ভয়াবহতার পরও প্রতিশোধের পথ ত্যাগ করে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মান রক্ষায় তিনি দেখিয়েছিলেন মহত্ত্বের নতুন সংজ্ঞা। তাঁর কাছে ন্যায়বিচার মানেছিল সত্যকে প্রকাশ করা, মানুষকে একসাথে দাঁড় করানো, আর নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস জাগানো।
নেতৃত্ব তাঁর কাছে ছিল ক্ষমতার আসনে বসা নয়; ছিল মানুষের কথা শোনা, তাদের অনুভূতিকে মর্যাদা দেওয়া, আর নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার। তিনি বিশ্বাস করতেন-
“মানুষকে ভালোবাসলে, মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে।”
তার জন্য শান্তি কেবল সংঘাতের অনুপস্থিতি নয়; শান্তি মানে এমন পরিবেশ, যেখানে প্রতিটি মানুষ বিকশিত হতে পারে, জাতি-ধর্ম-বর্ণের সীমা ছাড়িয়ে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর প্রভাত ছিনিয়ে নিয়েছিল তাঁর প্রাণ, কিন্তু নিভিয়ে দিতে পারেনি তাঁর প্রদীপ। আজও তিনি আছেন প্রতিটি প্রতিবাদী কণ্ঠে, প্রতিটি স্বপ্নময় চোখে, প্রতিটি ন্যায়ের দাবিতে। তাঁর অঙ্গীকার আজও বাতাসে ভেসে আসে-
“সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখা যাবে না।”
যতদিন শোষণ আর বৈষম্যের অন্ধকার থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্বলে থাকবেন বাঙালির প্রতিবাদের অগ্নিশিখা হয়ে, নেতাদের জন্য অনন্ত আলোকবর্তিকা হয়ে, আর মুক্তিকামী মানুষের চিরন্তন প্রেরণা হয়ে।