জুলাই ২০২৪: ব্যর্থ বিপ্লবের ময়নাতদন্ত । শাখাওয়াৎ নয়ন

জুলাই ২০২৪: ব্যর্থ বিপ্লবের ময়নাতদন্ত । শাখাওয়াৎ নয়ন

রাজনৈতিক ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে- জুলাই ২০২৪ বাংলাদেশের তেমনই একটি সন্ধিক্ষণ। এই সময়কে অনেকে বিপ্লব বলে অভিহিত করলেও, বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। তথাকথিত ‘জুলাই বিপ্লব’, ‘কালার বিপ্লব’, ফরহাদ মজহারের ভাষায় ‘গণ-অভ্যুত্থান’, এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভাষায় ‘রেজিম চেঞ্জ’ নামে পরিচিত ঘটনাটি ছিল এক দল অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক শক্তির দ্রুতগতির ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা, যা আদর্শ, নেতৃত্ব এবং নৈতিক অবস্থানে ছিল মারাত্মকভাবে দুর্বল।

ইতিহাসে যেমন আমরা ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) কিংবা রুশ বিপ্লব (১৯১৭)-কে দেখি যেখানে সুসংগঠিত নেতৃত্ব, আদর্শিক স্পষ্টতা এবং জনগণের সম্পৃক্ততা বিপ্লবের দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান ছিল সেই মানদণ্ড থেকে অনেক দূরে। এ নিবন্ধে বিশ্লেষণ করব কেন এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলো, এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো কী, এবং এটি কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ব্যর্থ গণ-অভ্যুত্থানের (যেমন মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া ও শ্রীলঙ্কা) ধারাবাহিকতাকেই অনুসরণ করেছে। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান কেবল শাসকের পতন নয়, রাষ্ট্র বিনির্মাণের দায়িত্বও আন্দোলনের অংশ ছিল—যা আন্দোলনকারীরা ভুলে গেছেন।

আগস্ট পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশি মিডিয়ায় একের পর এক মিথ্যাবয়ান তৈরি হলেও, জুলাই তার আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে পারছে না। কারণ, আন্দোলনকারীরাই জুলাইকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সকল আন্দোলনেরই একটি পরম সত্তা বা আত্মা থাকে। যদিও শুরুতে আন্দোলন ছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্য নিয়ে, জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসে এটি গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এই পর্যায়ে হেগেলের “Geist” বা “Absolute Spirit”-এর মতো এক পরমচেতনার জন্ম হয়েছিল।

দুঃখজনকভাবে, সেই পরম চেতনা ইতোমধ্যে মারা গেছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা ও অবিমৃষ্যকারিতার কারণে তাঁরা সেই নবজাতক চেতনাকে আতুরঘরেই হত্যা করেছেন। তাঁদের কর্মপন্থায় গভীর অসঙ্গতি এবং সুপরিকল্পনার অভাব ছিল। তাই জুলাই অভ্যুত্থানের অকাল মৃত্যুর কারণগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বিপ্লবের সাফল্যের জন্য সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—যা আমরা মিসরের আরব বসন্তের সময় দেখেছি। সঠিক সময়ে জনগণের সামনে বিপ্লবের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হলে, তাদের সমর্থন অর্জন করা যায় না। জুলাইয়ের আন্দোলনকারীরাও এই মৌলিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে এবং তাঁদের সক্রিয় সমর্থন হ্রাস পেয়েছে। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো বিপ্লবই স্থায়ী হতে পারে না।

তাঁরা শুরুতে ‘নতুন বন্দোবস্ত’-এর কথা বললেও, বাস্তবে তারাই ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, ভাষা আন্দোলন এবং জাতীয় চেতনার নানা অর্জন ও প্রতীকের (শহিদ মিনার, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, বিজয় স্মরণী) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষকদের অপমান করে তারা বাঙালির সামাজিক মূল্যবোধে আঘাত করেছে, ফলে জনগণ তাঁদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে।

জুলাই ব্যর্থ হয়েছে বহুমুখী কারণে। আন্দোলনকারীরা নিজেরা ক্ষমতায় না বসে কিংবা আংশিকভাবে বসে বহিরাগত সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। বিপ্লবের মৌলিক দর্শন হলো বিপ্লবীদের নিজস্ব নেতৃত্বে সমাজে এবং রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনা। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক দর্শন, নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব এবং জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের অভাব স্পষ্ট। মিসর ও লিবিয়ার ব্যর্থ বিপ্লবেও একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে।

অনেকে বলেন, ৫ আগস্ট বিপ্লব ক্লেইম করতে না পারাই ছিল ব্যর্থতার মূল। আমি একে বিপ্লব বলেই মনে করি না, কারণ এটি ছিল চাকরির বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন, যা পরে সরকারের পতনের উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত হয়। অনেকেই জানত না এটি যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত প্রকল্প—যা এনজিওদের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাই এনজিও কর্মকর্তাদের মতো এ আন্দোলনের নেতাদেরও ‘সমন্বয়কারী’ বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের ‘সমন্বয়কারী’ বলা হয়নি। কারণ সেই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে। পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল গৌণ। তাই আন্দোলনের সুফল তারা ঘরে তুলতে পারেনি, জাতিকেও দিতে পারেনি।

সংবিধান রক্ষা করার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে, তাঁরা একের পর এক সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। তিউনিসিয়াতেও দেখা গেছে, সংবিধান লঙ্ঘনের ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। একই ভুল জুলাই আন্দোলনকারীরাও করেছে, যার ফলে তাঁদের নৈতিক অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

তাঁরা নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে না পেরে ইনডেমনিটি আইন করেছে, যা বিপ্লবের নৈতিক অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। শ্রীলঙ্কাতেও ইনডেমনিটির ফলে জনসমর্থন কমে গেছে। জনগণ তাঁদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে।

আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের মতো জাতীয় ঐক্যের প্রতীককে প্রতিপক্ষ বানিয়ে বিভাজন তৈরি করেছে, যা জনগণের মধ্যে বড় ফাটল তৈরি করেছে। ফলে জাতীয় ঐক্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন’ নামে এক ‘সংবিধান লঙ্ঘন কমিশন’ গঠন করে দেশ ও জাতির সাথে তামাশা করছে।

ক্ষমতায় এসে তাঁরা পূর্বতন সরকারের চেয়েও বেশি দুর্নীতি, সহিংসতা, গুম, ধর্ষণ এবং মব সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে। এই নৈতিক দ্বিচারিতা জনগণ গ্রহণ করেনি। ফলে আন্দোলনকারীরা জনসমর্থন হারিয়েছে এবং তাঁদের অবস্থান অগ্রহণযোগ্য হয়েছে। ৫ আগস্টের পর স্পষ্ট হয়েছে, শেখ হাসিনাকে অপসারণ ছাড়া তাঁদের আর কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল না। পরিকল্পনার অভাবেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে—যেমনটা শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক সংকটেও দেখা গেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে “মেটিকুলাসলি ডিজাইন্ড” আন্দোলনের কথা বলেছেন, তা রাজপথের অনেক আন্দোলনকারী জানতেনই না। রাজপথে না বুঝে এক বা একাধিক বিশেষ গোষ্ঠীর নির্দেশিত এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন আন্দোলনকারীরা, এখন তাঁরা ভুল বুঝতে পারছেন। তাই প্রায়ই পত্রপত্রিকায় খবর আসছে—অসৎ, লোভী, দুর্নীতিবাজ ‘সমন্বয়কারীদের’ কমিটি থেকে জুলাই আন্দোলনকারীদের অনেকেই পদত্যাগ করছেন কিংবা করেছেন।

তাঁদের কারও কারও মুখে শোনা যায়, ‘ভাই, যেসব ভুঁইফোড় লোক হঠাৎ মন্ত্রী হয়ে গেল! শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল! সারাদেশে লাগামহীন নৈরাজ্য, অন্যায়, অপরাধ, খুন-ধর্ষণ-রাহাজানি, নির্যাতন, লুটপাট, গণডাকাতি চলছে—একদিন এ দেশের মানুষ এসবের জন্য আমাদের বিচার করবে। প্রায়ই মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আমি যেন ভাড়ায় খাটা একটা কীটপতঙ্গে পরিণত হয়ে গেছি। তখন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আন্দোলনকারী বলেছেন, ‘জুলাই ২০২৪ ছিল এক লক্ষ্যহীন, নেতৃত্বহীন ও আদর্শহীন উদ্যোগ। এটি ছিল কেবল সরকারের পতনের প্রচেষ্টা, রাষ্ট্র বিনির্মাণের কোনো রূপরেখা ছিল না। সব মিলিয়ে, এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে আরেকটি ‘রেজিম চেঞ্জ’ প্রকল্প, যা বাঙালির ইতিহাসে এক অস্থায়ী, আত্মঘাতী ও অনুতাপময় পর্ব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।’