সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পুণ্য করো দহন দানে । অজয় দাশগুপ্ত

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পুণ্য করো দহন দানে । অজয় দাশগুপ্ত

বাংলাদেশের আকাশে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা। ভাগ্যাকাশ প্রকাশিত আলোকিত হবার কালে হঠাৎ যে ঝড়, তার আঘাতে ছিন্নভিন্ন বাঙালির হৃদয়। আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন যে মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা, সেটাই এখন তোপের মুখে। না, আমি কোনো রাজনীতির কথা বলবো না। বলছি এমন দুঃসময়ে চলে যাওয়া সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথা।

তাঁর কি যাবার বয়স হয়েছিল? নিয়তি বা প্রকৃতি সময়মতো যাকে তুলে নেবেই। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা চলে গেলে তাঁদের বা পরিবারের যতটা ক্ষতি, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি সমাজের। সৈয়দ স্যার সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয় কেউ ছিলেন না। কেন ছিলেন না? ভাঁড়বেষ্টিত সস্তা জনপ্রিয় মুখ ও মুখোশের সমাজে তিনি বা তাঁর মতো কেউ প্রিয় হবেন কীভাবে? তাঁর লেখা তো জনগণের আয়না— যে আয়নায় মানুষ নিজেকে ভালো-মন্দ সবকিছু মিলিয়ে দেখতে পায়। সে আয়নায়, সে দর্পণে মুখ রাখা কি আসলেই সহজ না সম্ভব?

স্যারের একটা লেখার অংশ পড়ুন:

“আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে বুদ্ধিজীবীতার একটা বড় সংকট সহজেই ধরা পড়ে। বলে দেওয়া যায়, পেশাজীবীদের একটা বড় অংশ আর মানুষের সঙ্গে নেই, আছে সরকার বা নানান দলের সঙ্গে। তাঁরা নানা লোভনীয় পদ পাওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামেন। এখন সংস্কৃতির রাজনীতি, যা সংস্কৃতির সূত্রগুলো মানুষের জীবনে প্রয়োগ করে এবং তা থেকে শক্তি অর্জনের রাজনীতি— গুরুত্ব পায় না, পায় দলীয় রাজনীতির সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি দলের ভেতরের নেতাকর্মী ছাড়া অন্যদের জন্য হয় আত্মঘাতী। ফলে এখন তাঁরা আর মানুষের সংগ্রামে অংশ নেন না, মানুষের কাছে পরিবর্তনের, নতুন নির্মাণের কোনো বাণীও পৌঁছে দিতে পারেন না।”

তাঁর এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল— সৈয়দ সাহেবের বড় সাহস ছিল তাঁর কলমে। এর আগেও নানান লেখা ও মন্তব্যে তাঁর প্রতি সম্মান বেড়েছে বারবার। বেশ ক’বছর আগে তিনি বলেছিলেন, ভাষা দূষণ নদী দূষণের চাইতেও ভয়াবহ হয়ে উঠছে। তাঁর এই কথার সত্যতা যে কতোটা, সেটা বুঝিয়ে বলার দরকার দেখি না।

আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি মূলত ভাষা নির্ভর। বলতে গেলে দেশের জন্মসূত্রও ভাষাই। বাহান্নর ভাষা আন্দোলনই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। সে ভাষাই আজ বিপন্ন। নাটক, সিনেমা, সাহিত্য— সর্বত্র নবীন প্রজন্মকে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিকৃত, পাঁচ মিশালী এক বাংলা ভাষা। মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্প-সংস্কৃতির উগ্র বিরোধিতা করতে গিয়েই এই বিপত্তি। নিজেরা প্রমিত বানানে লিখেন বা প্রমিত বাংলা ছাড়া ভাষণ দেন না, কিন্তু তারুণ্যের মাথা বিগড়ে দিতে তাঁদের ধরিয়ে দেন উল্টোটা। যেমন আনিসুল হকের মতো লেখকরা।

বাকি যারা বোঝেন, এই প্রক্রিয়া ভালো না— তারা চুপ করে থাকেন। নিজেরা ঠিক পথে চললেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক কথা বলেন না। সৈয়দ স্যার সেটাই করেছিলেন দায়িত্ব নিয়ে। এর বাইরেও তাঁর কিছু কথা আছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া তাঁর কথাগুলো কী নির্মম সত্য! তিনি দুঃখ ও বেদনার সঙ্গে বলেছেন— কোথাও দার্শনিক, বিজ্ঞানী, লেখক কিংবা পণ্ডিতের দেখা মেলে না। চারদিকে শুধু প্রশাসক আর প্রশাসক।

তাঁর এই কথার সূত্র ধরেই বলি— প্রশাসক আর শাসক ছাড়া এখন কী-ই বা আছে? এভাবে যে একটি দেশ সামনে যেতে পারে না, সেটাই স্যার বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

তাঁর ব্যক্তিজীবনও খুব সাদামাটা অথচ উজ্জ্বল। তিনি ১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬৮ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৮১ সালে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন।

তাঁকে ভালো লাগার কয়েকটি কারণের ভেতর একটি কারণ ছিল পরিমিতিবোধ। আজকাল পরিমিতিবোধ বিলুপ্ত। সবাই কথা বলেন, সবাই লেখেন, সবাই ভাষণ দেন, সবাই সবজান্তা। কিছু মানুষকে দেখেও তারা শেখেন না যে চুপ থাকা আর কম জেনে বেশি বোঝাটাই হচ্ছে আধুনিকতা। সৈয়দ স্যার সে ধারার মানুষ, যিনি নিজেকে আড়াল রাখতে ভালোবাসতেন।

আমরা এক শ্রেণির পদক-উন্মাদ আর পদলোভী বোদ্ধাদের ভিড়ে আছি এখন। দেশের বরেণ্য, কবি-বয়সী কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা এখন আর বুঝে উঠতে পারেন না কী চাই, কেন চাই। এই “চাই-চাই” যুগে নির্লোভ মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। আমার সবসময় মনে হতো— তিনি চমৎকার মনের সাদাসিধে জীবনের মানুষ। যাঁদের কাছে পঠন-পাঠন আর জানাটাই মুখ্য।

সে ধরণের মানুষ চলে গেলে সমাজে হৈচৈ পড়ে যায় না। কিন্তু খুব সন্তর্পণে, চোরা স্রোতের মতো একটা গোপন দুঃখের ধারা বয়ে যায়। সে দুঃখ কখন যে চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ে— মানুষ নিজেই তা টের পায় না। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তেমনই এক ধরণের মানুষ।

সবচেয়ে দুঃখের কথা— তিনি তাঁর যাবার আগের সময়টুকুতে কোণঠাসা ছিলেন। তিনি একা নন, এখন এমন কোণঠাসা মানুষের সংখ্যা বিশাল— যাদের অনেকে হয়তো ভয়ে, অনেকে মনোবেদনায় একা আছেন। কিন্তু তিনি একা ছিলেন তাঁর বিবেক আর মেধার কারণে। আপনি তাঁর কথা বা লেখা শুনলে বা পড়লেই বুঝবেন— কোথায় ছিল তাঁর দুঃখ, কী ছিল তাঁর বেদনা।

আমি যেটা দেখি— বনসাইয়ের সমাজে, বামন জনগোষ্ঠীতে চিন্তা আর মেধায় অগ্রগণ্য একজন মানুষ ক্রমাগত ছায়া হয়ে গিয়েছিলেন। যখন ছায়া হয় মানুষ, তখন আসন্ন অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে— এটাই স্বাভাবিক। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাদের সর্বনাশ করে গেলেন, কিন্তু নিজে থাকলেন নক্ষত্র হয়ে। তারার আলোয় তাঁর অস্তিত্ব থাকবে, অথচ মাটি তাঁকে পাবে না।

কঠিন দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো বলি—

যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া

তবু বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর

এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা…

আমাদের চলতেই হবে। যাঁরা দধীচি হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন, আপন বুকের হাঁড় জ্বালিয়ে অস্ত্র তৈরি করে দিয়ে গেছেন— তাতেই লড়তে হবে।

শান্ত অথচ ঋজু, ভদ্র অথচ কঠোর, শীলিত অথচ দীপ্র— সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আপনাকে প্রণাম।

  • ১৩ অক্টোবর ২০২৫, সিডনি।