মানসিক প্রশান্তিতে রাগ সঙ্গীতের ভূমিকা । খন্দকার এনামুল হক

জোৎস্নারাত, গায়ের মেঠোপথের শেষ সীমানায়, যেনো নেমে এসেছে আলোকিত চাঁদ। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে গেছে। হঠাৎ সূদুর থেকে ভেসে আসছে পোড়া বাঁশির সুর। এ যেন ঘর থেকে মেঠোপথে নেমে যাওয়ার আহ্ববান। হারিয়ে যাওয়ার আহ্ববান। মন উদাসী হয়, হারিয়ে যায় অজানা-অচেনা কোন অধ্যায়ে।
কিন্তু এই ব্যস্ত শহুরে জীবনে, কোথায় পাওয়া যায় জোৎস্নারাতের ঘ্রাণ, কামিনীর মাতাল করা সুবাস, অথবা জোনাকীর সাথে নিবিঢ় কথোপকথন। কর্পোরেট জগতের এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, ভবিষ্যৎ এর অনিশ্চয়তা, সামাজিক বন্ধন, সবকিছু মিলে বিষিয়ে উঠেছে মন। কোথাও ঘুরতে গেলে ভালো লাগতো। অথচ সময় কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থাও একটা ব্যাপার।
এমন একটা অস্থির সময়ে, অস্থির মনকে শান্ত করতে পারে রাগ সঙ্গীত। কানে হেডফোন গুজে ইউটিউবে সার্চ করে একটা রাগসঙ্গীত চালিয়ে দিন।
বাঁশি, সেতার, সরোদ, সন্তর, তবলার সুরে-সুরে হারিয়ে যান, অতীতের কোন অধ্যায়ে, ফেলে আসা স্মৃতিতে বুদ হয়ে, কিছুটা বিষন্ন হওয়া যেতেই পারে। কিছুক্ষণ পর নিজেই অনুভব করতে পারবেন পুরো শরীরজুড়ে ঝর্ণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মস্তিস্ক জুড়ে নেমে এসেছে শীতলতা।সারাদিনের শত ক্লান্ত যেন নিমিষেই হারিয়ে যাচ্ছে।
অনেক গবেষণায় এসেছে, রাগসঙ্গীত শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি মন ও মস্তিষ্কের গভীর স্তরে প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে মানসিক প্রশান্তি, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কীভাবে রাগসঙ্গীত মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়?
মস্তিষ্কের তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: রাগসঙ্গীত ধীর ও সুশৃঙ্খল তালের মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভস (alpha, theta) সক্রিয় করে। এর ফলে মস্তিষ্ক শিথিল হয়, দুশ্চিন্তা কমে, একাগ্রতা বাড়ে।
হৃদয় ও স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে: নির্দিষ্ট রাগের কম্পন শরীরের উপর প্রশান্তিকর প্রভাব ফেলে। এটি হার্ট রেট ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে
আবেগ প্রশমন করে: যেসব রাগে ধীর গতি ও কোমল স্বর আছে (যেমন: Raag Yaman, Bageshree, Bhairavi, Desh), সেগুলো মনকে শিথিল করে। হতাশা, রাগ, ক্লান্তি কমাতে সাহায্য করে
ধ্যান ও মেডিটেশনের সহায়ক: অনেক ধ্যানচর্চায় রাগসঙ্গীত ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয় কারণ এটি মনকে ভিতরের দিকে নিয়ে যায়।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, রাগ থেরাপি ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ও ইনসোমনিয়া কমাতে কার্যকর। অটিজম ও ADHD আক্রান্তদের মনোযোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাগ:
রাগ ইয়মন
(বা যমান) উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ওপবিত্র রাগ। এটি সৌন্দর্য, রোমান্স ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসেবে ধরাহয়।
একটি সন্ধ্যাবেলার পবিত্র রাগ, যার সুরে জেগে ওঠে ভালোবাসা, প্রশান্তি ও ভক্তি।
রাগ ঝিঁঝোটি
উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি হালকা-প্রকৃতির (light-classical) রাগ। এর সুরে রয়েছে একধরনের সরলতা, স্নিগ্ধতা ও গ্রাম্যসৌন্দর্য, যা শ্রোতার মন সহজেই ছুঁয়ে যায়।
রাত (সাধারণত মধ্যরাতের আগে)
রাগ মিয়া মালহার
এটি একাধারে একটি ঋতুভিত্তিক রাগ এবং বর্ষা ঋতুর প্রতীক। বিশ্বাসকরা হয়, এই রাগ গাওয়া মাত্রই বৃষ্টি নামতে পারে — এমনই শক্তিশালীএক রাগ এটি!
সাধারণত সন্ধ্যা বা রাতের দিকে পরিবেশন করা হয়। এর মাধ্যমে বৃষ্টির আবহ তৈরি করা হয় সুরের মাধ্যমে।
শান্তি, প্রশান্তি, প্রকৃতির ছোঁয়া, বর্ষার মুগ্ধতা পেতে এই রাগের বিকল্প নেই।
রাগ মারওয়া
হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অত্যন্ত গম্ভীর, শক্তিশালী এবং গভীর অনুভূতির রাগ। এটি মূলত সূর্যাস্তের আগে পরিবেশিত হয়, যখন দিনের আলো ও অন্ধকারের সীমানা মিলিয়ে যায় – সেই আবহ তৈরি করে রাগ মারওয়া।
এক গম্ভীর, বিষন্ন ও সূর্যাস্তের রাগ।
উদ্বেগ, বিষন্নতা, গম্ভীরতা, অস্থিরতা, দার্শনিক উপলব্ধিতে এই রাগ চমৎকার কাজ করে।
রাগ নাট ভৈরব
হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি গম্ভীর, ভাবগম্ভীর ও আধ্যাত্মিক রাগ। এটি মূলত সকালের রাগ এবং এর সুর শ্রোতার মনে জাগায় একধরনের শান্ত, ভাবলেশহীন অথচ ভারী আবহ।
সকালবেলা (সকাল ৬টা থেকে ৯টা) সময় গাওয়া হয়।
গাম্ভীর্য, আধ্যাত্মিকতা, ভক্তিমূলক আবহ, প্রাতঃকালের সতেজতা ও স্তব্ধতা সৃষ্টিতে এই রাগ ব্যভহার করতে পারেন।
রাগ দেশ
হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও হৃদয়গ্রাহী রাগ।এর সুরে আছে বর্ষার কোমলতা, প্রেমের আবেদন এবং মাঝে মাঝেদেশাত্মবোধের গর্ব।
এটি মূলত বর্ষাকালের রাগ, কিন্তু এর ব্যবহারে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য—প্রেম, ভক্তি, এবং দেশপ্রেম সবই ফুটে উঠতে পারে এর মাধ্যমে।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর (প্রায় রাত ৮টা – ১১টা), তবে বর্ষায় যে কোনো সময়গাওয়া হয়।
প্রেম ও ভালোবাসা, কোমলতা,স্মৃতিময়তা, দেশপ্রেম (প্রধানত আধুনিকসংগীতে) এই রাগ ব্যবহার হয়।
রাগ মিয়াঁ কি তোড়ী
উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অত্যন্ত গম্ভীর ও সূক্ষ্মআবেগপূর্ণ রাগ। এর সুর গভীর বেদনা, বিষাদ এবং ভাবনার এক অদ্ভুতমিশ্রণ সৃষ্টি করে, যা শ্রোতার মনকে গভীরতা এবং ধ্যানমগ্নতায় নিয়েযায়।
সকাল ৮টা থেকে ১১টা এই রাগের জন্য উপযুক্ত সময়।
বিষন্নতা, গভীর ভাবনা, ধ্যান ও শোক, আত্মবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই রাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া আরো অনেক রাগ রয়েছে। ইউটিউবে সার্চ দিলে আপনি উপরিউক্ত রাগের মিউজিক ট্র্যাক পেয়ে যাবেন।
অবশেষে বলা যায়, রাগসঙ্গীত শুধু শ্রবণশক্তি দিয়ে উপলব্ধি করার বিষয় না। এটি হৃদয়ে ছোঁয়াতে হয়। শরীরে বহন করতে হয়। গভীর আত্মতৃপ্তির অনুভবের জন্য রাগ সঙ্গীতের বিকল্প কিছু নেই।
সূত্র: ইন্টারনেট
লেখক: লেখক ও এডিটোরিয়াল ডিজাইনার।