মাইলস্টোনে বিধ্বস্ত বিমান: শোক ও বিক্ষোভে স্তব্ধ বাংলাদেশ  

মাইলস্টোনে বিধ্বস্ত বিমান: শোক ও বিক্ষোভে স্তব্ধ বাংলাদেশ  
ছবি : সোহরাব আলম, বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ঢাকা থেকে : 

যেই শিশুরা বিদ্যালয়ে গিয়েছিল পাঠ নিতে, তারাই ফিরে এল লাশ হয়ে, যেই অভিভাবকেরা সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তাদেরও কেউ কেউ হতাহত হলেন। এমনকি এক শিক্ষিকা ২০টি অগ্নিদগ্ধ শিশুকে উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ৩১জনের মৃত্যু ও দেড় শতাধিক আহত রোগীর হাসপাতালে ভর্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে মাইলস্টোন বিদ্যালয়ের শিক্ষঅর্থীদের দাবি নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে। 

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়ন করার কয়েক মিনিট পরই বিধ্বস্ত হয়। বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামও মারা গেছেন।

দুর্ঘটনার পর আগুনে পোড়া শিশুদের যখন উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সন্তানের খোঁজে আসা বাবা-মায়ের আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, আগুনে পোড়া অনেক শিশুকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবার স্ট্রেচারের অভাবে কাউকে কোলে করে, কাউকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই দৃশ্য দুর্যোগ মোকাবিলার আমাদের অক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিমানটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে, তার কাছাকাছি আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। এ অবস্থায় মেট্রোরেলযোগে আহতদের দ্রুত জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে অনেকে এসেছেন স্বজনদের সহানুভূতি জানাতে। অনেকে এসেছেন স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে। বাংলাদেশর মানুষ আবারও প্রমাণ করল, তারা বিপদে সহায়তা করতে দ্বিধা করেন না। 

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আহতদের চিকিৎসার জন্য গণতহবিল আহ্বান করেছেন। আহতদের সুচিৎসার আশ্বাস দিয়েছেন। তারপরও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। 

এই মৃত্যু আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা ও অবহেলার স্মারক। বিমান দুর্ঘটনা আমাদের সামনে কতগুলো নির্মম সত্য তুলে ধরেছে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট বিমানটি চালাচ্ছিলেন। এ ক্ষেত্রে বিমানের কোনো ত্রুটি বা চালকের কোনো বিচ্যুতি ছিল কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার। এর আগে বাংলাদেশে একাধিকবার প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও এতগুলো প্রাণহানি ঘটেনি। বিমানটি এমন এক স্থানে বিধ্বস্ত হলো, যেখানে ছোট ছোট বাচ্চা ক্লাসরুমের ভেতরে ছিল। আমরা এ দুর্ঘটনা এড়াতে না পারলেও  এতগুলো প্রাণহানি এড়াতে পারতাম, যদি আমাদের যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের জন্য আলাদা রানওয়ে থাকত। যুদ্ধবিমান চালানোর জন্য যে বড় রানওয়ে দরকার, তা ঢাকার বাইরে কোথাও নেই। 

দুর্ঘটনার পরদিন রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বের হওয়ার পর দিয়াবাড়ি মোড়ে শিক্ষার্থীদের বাধার মুখে পড়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরারও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সেখান থেকে তাঁদের গাড়ি ঘুরিয়ে আবার কলেজ ক্যাম্পাসে নেওয়া হয়েছে। দুই উপদেষ্টা ও প্রেস সচিব কলেজের ভেতরে একটি ভবনে গিয়েছেন।কলেজের বাইরে ও আশপাশের এলাকায় শত শত শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা আইন উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টার পদত্যাগও দাবি করেন।

এর আগে বেলা পৌনে একটার দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিচ্ছি, আমরা প্রতিটা দাবি পূরণ করব। বিশ্বাস রাখেন।’ তবে উপদেষ্টার বক্তব্যের পরও বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকে শিক্ষার্থীরা। 

শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এসব দাবি হলো, নিহত ব্যক্তিদের সঠিক নাম-পরিচয় প্রকাশ; আহত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা; শিক্ষার্থীদের প্রতিটি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ; বিমানবাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরোনো প্রশিক্ষণ বিমান বাতিল করে আধুনিক ও নিরাপদ বিমান চালু এবং বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও কেন্দ্র সংস্কার করে আরও মানবিক ও নিরাপদব্যবস্থা চালু, শিক্ষকদের গায়ে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাত তোলার ঘটনার জন্য জনসমক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া।

এদিকে রাজধানীর সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ করছেনশিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে সেখানে বিক্ষোভশুরু করেন তারা। রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ডকলেজে বিধ্বস্তের ঘটনায় এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।গভীর রাতে  সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিক্ষোভরতশিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আরআবরারের পদত্যাগের দাবি জানান তারা।

বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডেরসামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের ফটকে যায়। যারাএসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেতাদের খাতাপুনর্মূল্যায়নের দাবিতেও সচিবালয়ের সামনে এসেছেনশিক্ষার্থীরা। 

মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড–সংলগ্ন বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের সামনে এই বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে নগরের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়ে বিক্ষোভ করেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই অবরোধের ফলে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে সড়কের দুই পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় এবং দূর-দূরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

মাইলস্টোন স্কুলের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা গোটা বা্ংলাদেশ শোকস্তব্ধ। শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘শোকসভা আজ বাংলাদেশ।’ 

ছবি কৃতজ্ঞতা : সোহরাব আলম, বাংলাদেশ।