ভাস্কর্য ভাঙলেই ভাঙেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । শাখাওয়াৎ নয়ন

১৯৯১ সালে রাশিয়ায় মার্ক্স-লেনিন-স্টালিনের ভাস্কর্য এবং পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যে সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্যের সঙ্গে ২০২৪ সালে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্যের কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে বামিয়ান বুদ্ধমূর্তি ভাঙার সঙ্গে সিরিয়ার আলেপ্পোতে হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস করার মধ্যেও কোনো পার্থক্য দেখি না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পরে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর রাজপথ যেভাবে বিপ্লবীদের বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, একইভাবে এখন বাংলার মাটি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। বেদনার ভারে ধীরে বইছে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা।
এসব কারা করছে? কে করাচ্ছে? স্থানীয় মীর জাফর, লাল-বদর, Type-Two রাজাকাররা করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করাচ্ছে। সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে তারা এক বা একাধিক ‘থিফ অব বাগদাদ’কে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সুখী-সমৃদ্ধ সিরিয়া ধ্বংস করে আইএস সন্ত্রাসীদেরকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আফগানিস্তানে নারী-শিক্ষা নিষিদ্ধকারী তালেবানদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। আরব বসন্তের নামে তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার মতো দেশগুলোকে ধ্বংস করেছে। ইরান ধ্বংসের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশে Merchant of Venice-এর সুদের কারবারি ‘শাইলকের বাণিজ্য বিস্তার’ মডেলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগে পৃথিবী গ্রিক, রোমান, অটোমান, মঙ্গোলীয়, মুঘল ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দেখেছে। পৃথিবী কি তাদের কুকীর্তি ভুলে গেছে? এই একুশ শতকে এসেও যুক্তরাষ্ট্র কেন অন্ধকারের পথে হাঁটছে?
আমেরিকা বিভিন্ন দেশে গিয়ে কেন স্থানীয় মীর জাফরদের দিয়ে এসব কুকর্ম করায়? কারণ তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে—পৃথিবীর সব জায়গায় তাদের আধিপত্য কায়েম করা এবং বিশ্ব-বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। মোদ্দা কথা—সমগ্র পৃথিবীকে লুটেপুটে খাওয়া। এসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তারা যেকোনো প্রতিরোধী শক্তিকে নির্মূল করে। এজন্য দেশ, জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতিভেদে একেক দেশে একেক রকম কৌশল গ্রহণ করে। তারা ইরানে ইসলামী শাসনের পতন ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানাতে চায়, আবার আফগানিস্তানে রাশিয়ার আশীর্বাদপুষ্ট ড. নজিবুল্লাহর সরকার উৎখাত করতে মাদ্রাসার ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তালেবানী ইসলামী বিপ্লব ঘটায়। অর্থাৎ যেখানে ইসলামী শাসন আছে সেখানে ইসলাম খেদাও; যেখানে নেই, সেখানে চাপিয়ে দাও। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা উৎখাত করে আফগানিস্তান মডেলের রাষ্ট্র বানানোর সংস্কার কাজ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই মাসে পিটার হাস ও ডোনাল্ড লুর প্রকল্প (২০১৮–২০২৪) বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জ করেছে। প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্থানীয় ‘শিশু মীর জাফর’রা, অর্থাৎ Type-Two রাজাকাররা, শুরুতে একে নিজেদের বিজয় বলে দাবি করে। বুড়ো মীর জাফর তাদের কয়েকজনকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয়ও করিয়ে দেন। কিন্তু তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু বেজায় নাখোশ হয়ে সরাসরি জানিয়ে দেন—তারা কাকে কত টাকা দিয়ে কিনেছে এবং কীভাবে বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জ ঘটিয়েছে। মর জ্বালা!
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙলেই কি বঙ্গবন্ধু ভেঙে যাবেন?
জাদুঘরসহ সব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন করলেই কি ইতিহাস মুছে যাবে? ইতিহাস কখনোই শুধু পাথরে খোদাই করা কোনো মূর্তি কিংবা ব্রোঞ্জে গাঁথা একখণ্ড ভাস্কর্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ইতিহাস বয়ে চলে মানুষের স্মৃতি, সংগ্রাম, সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয়ের গভীরে। এটি মানুষের অভিজ্ঞতা, জাতির যৌথ চেতনা ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা লোক-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে। তবুও ইতিহাসের নানা বাঁকে দেখা গেছে—কোনো একটি রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি বা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কিংবা সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বহু দেশে ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে গড়া ভাস্কর্য, ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হয়েছে। এই ধ্বংসের উদ্দেশ্য ছিল ইতিহাসের একটি অংশকে আড়াল বা অস্বীকার করা। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়- এই প্রতীকগুলো ভেঙে ফেলার পর পৃথিবীর কোথাও কি কোনো ইতিহাস মুছে গেছে?
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বহুবার আমরা এই ধরনের ‘স্মৃতি ধ্বংসের রাজনীতি’ প্রত্যক্ষ করেছি। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তিদ্বয় ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। তাদের দাবি ছিল, ইসলাম ধর্মে মূর্তি পূজার স্থান নেই, তাই এসব ইতিহাসবাহী নিদর্শন ইসলামবিরোধী। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমাজ এই পদক্ষেপকে শুধু ধর্মীয় গোঁড়ামি নয়, বরং মানব সভ্যতার ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ওপর আঘাত হিসেবে দেখেছিল। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তালেবানরা ইতিহাস নিশ্চিহ্ন করতে চাইলেও বামিয়ানের মূর্তি আরও বেশি আলোচিত ও মূল্যবান হয়ে ওঠে।
ঠিক তেমনই, সিরিয়ার পালমিরা শহরে আইএস কর্তৃক প্রাচীন রোমান স্থাপত্য ধ্বংস করা হয়। তাদের দাবি ছিল- এগুলো মূর্তিপূজার নিদর্শন। কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো ছিল মানব সভ্যতার নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিফলন। এই তাণ্ডব ইতিহাসকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা হলেও কার্যত তা ইতিহাসের প্রতি মানুষের আগ্রহ, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার চেষ্টাকে আরও গভীর করে তোলে।
একই প্রবণতা আমরা দেখি যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে Black Lives Matter আন্দোলনের সময় দক্ষিণের কনফেডারেট নেতাদের বহু ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয় কিংবা সরিয়ে নেওয়া হয়। যদিও সেগুলো ছিল দাসপ্রথা ও বর্ণবাদী অতীতের প্রতীক, তবুও অপসারণ নিয়ে ছিল মতভেদ। কেউ মনে করেন, এসব অপসারণ ইতিহাস মুছে ফেলার নামান্তর; আবার অনেকে বলেন, এটি একটি অন্ধকার অতীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। বাস্তবে এসব উদ্যোগ ইতিহাসকে চাপা না দিয়ে বরং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও চেতনার বার্তা জাগিয়ে তোলে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর দেখা যায়, পুরো অঞ্চলে- এমনকি পূর্ব জার্মানিতেও- ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার এক ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। কার্ল মার্ক্স, লেনিন, স্টালিনের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্যগুলো সিএনএন, বিবিসিসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। বলশেভিক বিপ্লবের প্রায় সব স্মারক মুছে ফেলার চেষ্টার পেছনে পরামর্শদাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। যারা আবার একই মুখে সভ্যতার কথাও বলে!
মার্ক্স ও লেনিনের পরে যুক্তরাষ্ট্র স্টালিনকে টার্গেট করে। যদিও স্টালিন কোনো তাত্ত্বিক ছিলেন না, তবুও “স্টালিনবাদ” শব্দটি আজও বহুল প্রচলিত। কেন? যুক্তরাষ্ট্র জানত- শুধু মার্ক্স-লেলিন নয়, স্টালিনকেও মুছে ফেলতে হবে, কারণ তিনিই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাশক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারবিরোধী জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ফলে পশ্চিমা মিডিয়া গত ৫০ বছর ধরে তাঁকে ‘জাতীয় শত্রু’ হিসেবে চিত্রিত করে যাচ্ছে।
এই একই সুরে বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জাসদ নেতারা “মুজিববাদ” শব্দটির নেতিবাচক প্রচলন ঘটান। যদিও বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদারপন্থী ও জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক।
২০২০ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী আপত্তি তোলে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে- তিনি কি কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন? না কি তিনি জাতির ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক? বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম তাঁর নেতৃত্বেই। তাঁকে অস্বীকার করা মানে রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা।
মূল লক্ষ্য- বাংলার গৌরবকে নিশ্চিহ্ন করা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বৈশাখী মেলা, বাউল ও লোকসংস্কৃতি ধ্বংসের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয়কে বিলুপ্ত করার অপচেষ্টা।
এই ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যেখানে ইতিহাস হয় ক্ষমতার হাতিয়ার। কিন্তু ইতিহাস ধ্বংসযোগ্য নয়। ভাস্কর্য, বই বা পাঠ্যক্রম ধ্বংস করলেও ইতিহাস মানুষের চেতনায় টিকে থাকে।
ইতিহাস কেবল বস্তুগত নয়- এটি আবেগ, স্মৃতি ও চেতনার বিষয়। একটি ভাস্কর্য একটি জাতির গৌরব, ব্যথা বা বিজয়ের প্রতীক। ভাস্কর্য ধ্বংস মানে জাতির মানসিকতায় আঘাত। এই আঘাত কখনো কখনো গণপ্রতিবাদ ও আত্মসচেতনতার জন্ম দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, বিজয় স্মরণীর ম্যুরাল বা বীরশ্রেষ্ঠদের ভাস্কর্য আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ। এগুলোর ওপর আঘাত মানেই আমাদের অস্তিত্বে আঘাত।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ইতিহাসকে নিঃশেষ করার যত চেষ্টাই হোক, ইতিহাস মানুষের স্মৃতি, প্রতিবাদ, কবিতা, গান, সাহিত্য ও চেতনায় বেঁচে থাকে। প্রতিটি ধ্বংসই ইতিহাসকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। সুতরাং, একটি জাতির গৌরবের ভাস্কর্য, ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেললেই ইতিহাস মুছে যাবে না- বরং ইতিহাস আরও গভীরভাবে মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে।