ভবের হাটের গীতিআলেখ্যে মুগ্ধ সিডনিবাসী । আরিফুর রহমান 

ভবের হাটের গীতিআলেখ্যে মুগ্ধ সিডনিবাসী । আরিফুর রহমান 
শীতের সন্ধ্যা যখন ঢেকে যাচ্ছিলো সিডনির পশ্চিম দিগন্তে, ক্যাসুলা পাওয়ার হাউজ মিলনায়তন তখন প্রস্তুত হচ্ছিল এক অন্য রকম জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়ার জন্য। এই জ্যোৎস্না প্রকৃতির নয় এটি ছিল শিল্পের- বাংলার, শিকড়ের, গীতিকাব্যের। এটি ছিল আমাদের সিডনির চিরচেনা ভবের হাটের গীতি আলেখ‍্য। 
 
গত ২৮ জুন শনিবার সন্ধ‍্যায় ক‍্যাসুলা পাওয়ার হাউজ অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয়েছে ভবের হাটের নবম সিরিজের মনোরম পরিবেশনা।  বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতের মধ‍্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। 

ময়মনসিংহ গীতিকা ছিলো এবারের ভবের হাটের প্রধান আলেখ‍্য। সেখান থেকে গাওয়া হয়- সখীগো আমার মন ভালো না সহ বেশ কয়েকটি গীতিকবিতা। অনুষ্ঠানটির প্রাণবন্ত সঞ্চালনা করেন শাকিল চৌধুরী। পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও গ্রন্থনায় ছিলেন ফারিয়া আহমেদ। সিডনিবাসী গুণী নৃত্যশিল্পী অর্পিতা সোমচৌধুরীর কোরিয়গ্রাফিতে মূর্ত হয়ে ওঠে বাংলার গ্রামীণ আবহ। অনুষ্ঠানে আলোক প্রক্ষেপণে ছিলেন রাজন নন্দী। 

অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেন ফারিয়া আহমেদ, লামিয়া আহমেদ, নীলাদ্রি চক্রবর্তী, বনফুল বড়ুয়া প্রমুখ। অনুষ্ঠানে যন্ত্রশিল্পী হিসেবে ছিলেন সিডনির প্রখ‍্যাত শিল্পীরা- তবলায় বিজয় সাহা, গিটারে সোহেল খান ও বনফুল, অক্টোপ্যাডে আলী কাওসার, দোতারায় ফয়সাল সজীব, মন্দিরায় লোকমান হাকিম এবং কী-বোর্ডে নিলাদ্রী চক্রবর্তী। সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ছিলেন আত্তাবুর রহমান। মঞ্চসজ্জা ও প্রজেক্টর পরিচালনায় জাকী খন্দকার ও সুমন কবীর। অনুষ্ঠানের স্পন্সর ছিলো ওয়ান স্টপ বিল্ডারস ও মিন্টো ডিসকাউন্ট ফার্মেসি। 

অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে আয়োজন করা হয় ‘গুণীজন সংবর্ধনা’। আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার আত্তাবুর রহমান, মো. লুৎফুর রহমান টিপু, রোকসান বেগম, মালা ঘটক চৌধুরী, নিশাত আরা সিদ্দিক রিপা। তাদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন শিল্পী ও সংগঠক সিরাজুস সালেকিন ও  নাজমুল আহসান খান।  

বাংলা লোকসংগীত কেবল সুর নয়, এটি সময়ের ধারায় হারাতে বসা মানুষের ভাষা। সে ভাষা আবার ফিরে এসেছিল সেই সন্ধ্যায় ফারিয়া ও লামিয়া আহমেদ লুনিয়ার কণ্ঠে। তাঁরা গেয়েছেন যেন পল্লীর মাঠ থেকে উঠে এসেছে ঘাসফুলের গন্ধ, যেন লাঙ্গলের টানে জেগে ওঠে মাটির নিঃশ্বাস, যেন গানের ভেতর দিয়ে কথা বলে শাহ আব্দুল করিমের নদী, হাসনের হাহাকার আর লালনের পরমতত্ত্ব।

তাঁরা গান গাইছিলেন না যেন আত্মা দিয়ে কথা বলছিলেন। আর পুরো অডিটোরিয়ামের দর্শক বুঁদ হয়ে উপভোগ করছিলেন। আমি অনেকের মুখের দিকে চেয়ে এক ধরণের স্নিগ্ধ, মুগ্ধতা, প্রাপ্তির পরশ খুঁজে পেয়েছি। ভবের হাট ইতোপূর্বে আটটি আসর করে ফেলেছেন। এটি তাদের নবম আয়োজন। এর আগে আমার যাওয়া হয়নি। বন্ধু নজরুলের আমন্ত্রণে আমি আর ফয়সাল তার সফরসঙ্গী না হলে এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা থেকে বঞ্চিত হতাম নিশ্চিত। 
ভবের হাটের পরিবেশনায় কখনও নৈঃশব্দ্যে, কখনও ছন্দময় পদক্ষেপে ফুটে উঠছিল প্রেম, বেদনা, অপেক্ষা ও হারানোর ব্যথা। এই গীতিকা কেবল কাহিনি নয় এ যেন এক পুরাণ, যেখানে সময়ের সীমানা পেরিয়ে আজকের সিডনি শহরে এসে দাঁড়ায় কৃষকের প্রেম, রাখালের কান্না আর নদীর ওপারে হারিয়ে যাওয়া কোনো নামহীন চরিত্র।
অর্পিতা সোমচৌধুরী সিডনির খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী। আলো যখন ধীরে ধীরে মঞ্চকে আলিঙ্গন করছিল, ঠিক তখন নীরবতাকে ভেদ করে উঠে এল এক সুর এবং সেই সুরের শরীর হয়ে উঠে দাঁড়ালেন অর্পিতা। অর্পিতা যেন অঙ্গ দিয়ে কথা বলছিলেন। তাঁর প্রতিটি ভঙ্গিমা ছিল সংলাপ, প্রতিটি মোচড় ছিল উচ্চারণ, প্রতিটি দৃষ্টিক্ষেপ ছিল এক অনুচ্চারিত কবিতা।
উপস্থাপক শাকিল আহমেদের সাথে পরিচয় নেই আমার। তার উপস্থাপনায় ছিলো ভাষার সৌন্দর্য, রসবোধ, হৃদয়গ্রাহী সংযম এবং বিষয়প্রেমের আন্তরিকতা। সিডনির অন‍্যান‍্য মঞ্চ কিংবা আয়োজকেরা তাঁর এই ভরাটকন্ঠ এবং বাচিকতা কাজে লাগাবেন বলে আমার বিশ্বাস। 
ভবের হাটের এই আয়োজনে অংশগ্রহণ শুধু একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা দেখা নয় এটি যেন নিজের শিকড়ে ফিরে তাকানোর আয়না যেখানে বাংলার পল্লীজীবন ও নগরের মনন একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছিলো। 
সিডনির মাটিতে এক টুকরো বাংলাকে দেখা এই অভিজ্ঞতা আর শুধু মনে নয় গেঁথে রইল আমাদের বোধে।