আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক : জয়তু বঙ্গবন্ধু । অজয় দাশগুপ্ত

আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক : জয়তু বঙ্গবন্ধু । অজয় দাশগুপ্ত

গত বছর আমি দেশ থেকে ডেঙ্গু নিয়ে ফিরেছিলাম। যখন ফিরে আসি, তখনো বুঝতে পারিনি যে সহসাই পরিবর্তনের খেলায় বদলে যাবে বাংলাদেশ। আমি সুস্থ হয়ে ওঠার আগেই সরকার পরিবর্তনসহ শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। আমাদের পারিবারিক বিপর্যয়ও ঘটেছিল ঠিক তার আগে। দীপার বাবা চলে গেলেন তারার দেশে। সব মিলিয়ে সে এক অসহনীয় পরিস্থিতি। যা ঘটেছিল, তা সবাই জানেন। কিন্তু আমি বলছি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর নিয়ে।


যেদিন সে ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো এবং বুলডোজার দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ভেঙে ফেলা হলো, সেদিন রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম—আমি তো আওয়ামী লীগ করি না, আমি তো শেখ হাসিনার অন্ধ সমর্থক নই, আমি কখনো আওয়ামী লীগের কাছে কোনো তদবির করিনি, আমি তাদের বিবেচনায় কোনো পুরস্কার বা পদকও পাইনি। জীবনে কোনোদিন কোনো লেনদেন হয়নি কারো সাথে। শেখ হাসিনা যখন সিডনি সফরে এসেছিলেন, তখন আওয়ামী লীগারদের রমরমা। বহু দল-উপদলে বিভক্ত সিডনির নেতারা স্টেজ দখল করে বসে ভাষণ দিয়েছেন- যাদের কেউ কেউ এখন আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণেও ভয় পায়। পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা বাদে বাকিরা এখন শীতনিদ্রায় মগ্ন। লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিজনদের তারা মঞ্চের বাইরে রেখেছিলেন।

তারপর দিন অনেক প্রবীণ লেখক (বর্তমানে প্রয়াত) সহ অনেকে যখন শেখ হাসিনার সাথে একটি ফটো তোলার জন্য হোটেলে গিয়ে ধর্ণা দিয়েছিলেন, আমি সেখানেও যাইনি। তেমন কোনো ছবি তোলার অভিলাষ আমার কোনো কালে ছিল না, এখনো নেই। ফলে যারা এখন ফটো লুকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, তাদের মতো আমার কোনো দুর্ভাবনা নাই।

চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রা-য় আওয়ামী সরকারের সমালোচনা ও ব্যর্থতার যৌক্তিক বিশ্লেষণের কারণে আমার বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছিলেন সিডনির কেউ কেউ। তারপরও আমি ধানমন্ডি ৩২ ভাঙার পর শিশুর মতো কেঁদেছি, সারারাত ছটফট করেছি- যেন আমার নিজের, আমাদের কারো বাড়ি ভেঙে ফেলা হচ্ছিল। অসুস্থতার জন্য সিডনির কোনো শোকসভায় যেতে না পারার কষ্ট আমাকে তিলে তিলে দগ্ধ করেছিল সে সময়।

প্রশ্ন হচ্ছে- আমি তো না-ই বা আওয়ামী লীগ করি, আমার চাইতেও অধিক কষ্ট পেয়েছেন যারা, তারা তো রাজনীতি করেন না, দলের নামে টাকা কামাননি, তবু সেদিন কেন তারা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন? বর্তমান সময়ে আপনি দেখবেন- আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে পদ, পদক, অর্থ হাতিয়ে নেওয়া কাউকে মাঠে পাবেন না। ফজলুর রহমান, মাসুদ কামাল, আনিস আলমগীরের মতো যারা প্রতিবাদে মুখর, তাঁরা লীগের কেউ না। কিন্তু দুঃসময়ে এরাই মাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন।

আমার মতো যারা একাত্তর দেখা প্রজন্ম, যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা দেখেছি, আমরা কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর অপমান মেনে নিতে পারি না। একটা বিষয় খেয়াল করবেন- আজীবন সংগ্রাম করা এই নেতার মূল্যায়ন নাকি মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন! মূর্খ আর উদ্দেশ্যপ্রবণ না হলে এ কথা কেউ বলতে পারে? শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধুতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, এরা তা জানে না।

১৯৯৫ সালের জাতীয় শোক দিবসে আমি মূল প্রবন্ধ পাঠের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। সে অনুষ্ঠানে সুলেখক, অধ্যাপক, সম্পাদক প্রয়াত মুস্তাফা নূরুল ইসলাম ছিলেন প্রধান অতিথি। সেদিন তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ অসাধারণ বাচনভঙ্গীতে শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার কারণ বলেছিলেন। সেদিন থেকে আমি জানি- বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নাই।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যখন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য যাচ্ছিলেন, তখন তিনি চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে জনতার ভালোবাসার স্রোতে মাঝে মাঝে থেমে কথা বলেছিলেন। এনায়েত বাজারে আমার খেলাঘরের পক্ষ থেকে তাঁকে মাল্যভূষিত করার বিরল সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই একবারই আমরা এই মহীরুহকে দেখি। স্বাভাবিক বাঙালির চাইতে দীর্ঘ যে তিন-চারজন বাঙালি—তাদের কাউকে আমরা সহজে মেনে নিতে পারিনি, পারি না। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, সত্যজিৎ রায় বা সুধীন্দ্রনাথ নজরুল- সবার প্রতিই আমাদের এক অদ্ভুত হিংসা, যেটা রক্তাক্ত করাতেই আনন্দ খুঁজে পায়। সেদিনকার দেখা বঙ্গবন্ধু এরপর মাত্র তিন মাস বেঁচেছিলেন।

১৯৭৫-এ তাঁকে নির্মমভাবে পরিবারসহ হত্যা করার পরও এদের আক্রোশ মেটে নি। এই আক্রোশের মূল কারণ- বঙ্গবন্ধু কখনো মরেন না। তাঁর শরীর মৃত হলেও আত্মা অবিনশ্বর। আমার মনে আছে- আওয়ামী লীগের ঘোর দুঃসময়ে প্রয়াত কালম লেখক, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো খ্যাত আবদুল গাফফার চৌধুরীর সাথে কথা হলেই বলতেন, “লিডার সব দেখছেন, বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদে আমার পথ খুঁজে পাবোই।”

সে পথ আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। কিন্তু গদি, শাসন আর অর্থের মোহে আদর্শ যখন থেকে পিছু হটতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই মূলত সমস্যার শুরু। শেষে এমন হলো- বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর দাঁড়িয়ে ভেঙে ফেলা বা তাঁর নিজস্ব বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময়ও আমরা কাউকে দেখতে পেলাম না। পাকিস্তানিরা যা পারেনি, তা করে দেখিয়েছে তাদের রেখে যাওয়া স্তাবকেরা।

আমি কোনো গণহত্যা বা নিধনের সাফাই গাইতে রাজি নই। যার যা পাপ, যা কৃতকর্ম- তার জবাব তাকেই দিতে হবে, ফলও পেতে হবে। কিন্তু আমার মতো লাখো কোটি বাঙালির একটাই প্রশ্ন- যে মানুষটি ৫০ বছর আগে জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করার মূল্য চুকিয়ে গেছেন, তাঁর ওপর এত রাগ, এত আক্রোশ কেন? আমরা কি শিশু না জাতি অন্ধ, যে এর কারণ বুঝতে পারি না? কন্যার দায় পিতার ওপর চাপানোর ভেতর মারাত্মক যে খেলা, তার ফলাফল ভোগ করতেই হবে এদের।

বঙ্গবন্ধু এখন আর শুধু শোকের প্রতীক নন- তিনি এই জাতির ইতিহাস ও সাহস। তিনি শারীরিকভাবে নেই, কিন্তু তাঁর ছায়া আছে। বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস, নদী, সাগর, পাখি- সবকিছুতে আছেন তিনি। জীবনের সিংহভাগ জেল-জুলুম খাটা শেখ মুজিবুর রহমান কোনো হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা ছিলেন না। বাঙালির নাড়ি, বাঙালির জীবন, বাঙালির অস্তিত্বের আরেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

“ন হণ্যতে” উপন্যাসের মুখবন্ধে উদ্ধৃত শ্লোকটির কথা মনে পড়ছে- 

অজো নিত্যঃ শ্বাশ্বতো হায়ং পুরাণো,

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।

এই আত্মা জন্মরহিত, শ্বাশ্বত ও পুরাতন;

শরীরকে হনন করিলেও ইনি নিহত হন না।

কারো সাধ্য নেই তাঁকে মুছে ফেলার। আমাদের এবং আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের চোখের পানিতে বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর কর্মই তাঁর জীবনকে আগলে রাখবে অনন্তকাল।