অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ কতদিন হওয়া উচিত । সোহরাব হাসান

৩০ জুলাই ডেমোক্রেসি ডায়াস বাংলাদেশের উদ্যোগে গণতান্ত্রিক উত্তরণ, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন নিয়ে এক সংলাপের আয়োজন করা হয় স্থানীয় এক হোটেলে। এতে রাজনীতিকদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান মওদুদ আহমদ আলমগীর পাভেলের সভাপতিত্বে এই আয়োজনে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন।
গবেষণায় ২৬টি অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়, যেসব দেশে অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্বল্পমেয়াদে ক্ষমতায় থেকেছে, সেসব দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেছে, অর্থনীতি গতিশীল হয়েছে। আর যেসব দেশে দীর্ঘসময়ের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পালন করেছে, সেসব দেশে সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
উল্লিখিত ২৬টি দেশের প্রথম ভাগে আছে ১৩টি দেশ যথাক্রমে গ্রিস, বেলজিয়াম, ইউক্রেন, পোলান্ড, সাবেক পূর্ব জার্মানি, রোমানিয়া, সাবেক চেকস্লোভাকিয়া, তিউনেসিয়া, ইন্দোনেশিয়া, নেপাল, চিলি, ইতালি ও হাঙ্গেরি। এর মধ্যে প্রথম ৭টি দেশে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থেকেছে সর্বনিম্ন এক মাস থেকে সর্বোচ্চ ৯ মাস পর্যন্ত। অন্যদিকে শেষের ৬টি দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ছিল ১ বছর দুই সপ্তাহ থেকে ১ বছর পাঁচ মাস।
অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে অন্তর্বর্তী সরকার ছিল যথাক্রমে স্পেন, থাইল্যান্ড, গ্যাবন, পর্তুগাল, লাইবেরিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, শ্রীলঙ্কা, হাইতি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, লিবিয়া, মালি ও সুদান। এর মধ্যে স্পেনে সর্বনিম্ন ১ বছর ৭ মাস ও শ্রীলংকায় দুই বছর দুই মাস অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থেকে দেশের গণতন্ত্র উত্তরণে সফল হয়েছে। কিন্তু হাইতি, নাইজার, বুরকিনা ফাসো, লিবিয়া, মালি ও সুদানে অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় গণতন্ত্র উত্তরণ থমকে আছে। কবে এসব দেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হবে, তারও নিশ্চয়তা নেই।
গবেষণায় বাংলাদেশে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিও উঠে এসেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে আর্থ-সামাজিক অবস্থা নাজুক হচ্ছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে আর জননিরাপত্তা হয়ে পড়েছে আরও ভঙ্গুর।
যেমন দারিদ্র্যের হার ২০২৪ সালে ছিল ২০.৫ শতাংশ, বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৫ সালে এটি ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাবে। ২০২৩ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বরে দেশে বেকার ছিল ২৭.৩ লাখ, ২০২৫ সালের অক্টোবর প্রান্তিকে এটি ৩১.১ লাখ ও ২০২৬ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকে ৩৫.৩ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস করা হচ্ছে। প্রকৃত বেকারের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলেছে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে যে ভীতি, দমন-পীড়ন ও গুমের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটত, তার কিছুটা অবসান ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কথিত রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনে নির্বিচার আটক করছে। মানবাধিকার সুরক্ষায় তারা এখনো কাঠামোগত সংস্কার আনতে পারেনি।
সংস্থাটির এশীয় অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার যেন এক জায়গায় আটকে আছে। একদিকে সংস্কারবিহীন নিরাপত্তা বাহিনী, অন্যদিকে মাঝেমধ্যে সহিংস ধর্মীয় কট্টরপন্থী এবং এমন কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে সামলাতে হচ্ছে, যারা বাংলাদেশিদের অধিকার রক্ষার চেয়ে শেখ হাসিনার সমর্থকদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বেশি আগ্রহী।’
এইচআরডব্লিউয়ের প্রতিবেদনে মব ভায়োলেন্স ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও স্বীকার করেছেন, আমাদের সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, একটা হচ্ছে মিথ্যা মামলা। মামলা হতে পারে, কিন্তু মিথ্যাভাবে লোককে ফাঁসানো, মানে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা; আরেকটি হচ্ছে মব সন্ত্রাস।’
(প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০২৫)
ডেমোক্রেসি ডায়াসের সংলাপে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, যেকোনো অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বদা তার এক্সিট পলিসি (নিষ্ক্রমণ পদ্ধতি) সম্বন্ধে চিন্তা করা উচিত। তিনি বলেন, এই সরকারেরও (অন্তর্বর্তী সরকার) সময় এসে গেছে এক্সিট পলিসি চিন্তা করার। একইসঙ্গে যেটুকু সময় আছে, এর ভিতর দিয়ে এই সরকার আর কী অর্জন করে বের হয়ে যেতে চায়– জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মধ্য দিয়ে সেটাও বলার সময় এসেছে।’
বাংলাদেশে এর আগে ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৭ সালে চারটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এর মধ্যে গঠিত প্রথম তিনটি সরকার তিন মাসের মধ্যে সফল নির্বাচনের আয়োজন করে বিদায় নিয়েছে।
১৯৯০ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকার এসেছিল এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে। এবারে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারও আসে চব্বিশের জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, সাহাবুদ্দীন তিন মাসে পারলে ইউনূস দুই বছর সময় লাগাচ্ছেন কেন?
ইয়াজউদ্দিন আহম্মদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। তারা শুরুতেই দুই বছরের সময়সীমা বেধে দিয়েছিল।
এর আগে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার কারণে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব না নেওয়ায় তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে বর্ণিত অন্য বিকল্প না খুঁজে নিজেদের পছন্দসই রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। সেই সরকার ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনটি করতে পারেনি। রাষ্ট্রপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রভাবশালী চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে তো সে রকম কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানে পদচ্যুত আওয়ামী লীগ ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তারপরও নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের মতভেদ স্পষ্ট।
বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার ডিসেম্বর–জুনের দোলাচলে দুলতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে এপ্রিল মাসে লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে ঠিক হয় বিচার ও সংস্কার কাজের অগ্রগতি হলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে।
তারপরও নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় থেকে যাচ্ছে। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্য এই সংশয়কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারের মেয়াদ এক বছর পার হতে যাচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের কবে হবে, সে নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার আইন উপদেষ্টা বলেছেন, শিগগিরই নির্বাচনের তারিখ জানা যাবে। নানা সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বার্ষিকীতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে সুনির্দিষ্ট তারিখ জানাতে পারেন। কিন্তু তারপরও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
যেই জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন বা ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপথ নির্ধারিত হবে, সেটি চূড়ান্ত করা যায়নি রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্যের কারণে।
অনেক মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মতবিরোধ আছে। বিএনপি ও এর সহযোগীরা চায় নির্বাচিত সংসদ এটি বাস্তবায়ন করবে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনের দাবি এখনই অধ্যাদেশ জারি করে কিংবা গণভোটের মাধ্যমে এখনই সেটি করতে হবে। গণভোটের দাবিকে অনেকে নির্বাচন পিছিয়ে নেওয়ার কৌশল বলে মনে করেন।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাজনৈতিক ঐক্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি, তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অসম্ভব কিছু নয়।’
রাজনৈতিক অঙ্গনে যে নানা রকম জল্পনা আছে, তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল বিএনপির নেতার মুখে। সমালোচকেরা বলছেন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ যদি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন, মুহাম্মদ ইউনূস কেন ১৮ মাসে পারবেন না?