মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড কি অবসেশন বা অবচেতন মনের হাহাকার । সালেহ আহমেদ জামী 

মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড কি অবসেশন বা অবচেতন মনের হাহাকার । সালেহ আহমেদ জামী 
'নরওয়েজিয়ান উড' বিটলসের জনপ্রিয় গানগুলির একটি। বইটি পড়ার আগে গানটি শোনা হয়নি। পড়ার পথে একবার শুনলাম আর পড়া শেষে আবার শুনলাম। উপন্যাসের নামকরণ যথার্থ হয়েছে। সেই যথার্থতার কারণ জানাবো একেবারে শেষে।
 
বইটি মূলত এক জাপানিজ যুবক - তরু ওয়াতানাবের জবানে লেখা বর্ণনামূলক একটি উপন্যাস। এর আগে জাপানের কোন সাহিত্যিকের উপন্যাস পড়া হয়নি তাই আগ্রহ ছিল নতুন কিছু অবগাহনের। সেই সুযোগ মিলেছে এবং প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমার অনার্সের তৃতীয় বর্ষে আঞ্চলিক ভূগোল পড়ার সময় তিনটি রাষ্ট্রকে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। আমি পছন্দ করেছিলাম জাপান, ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র। সেই তখন থেকেই জাপানকে ঘিরে একটা আগ্রহের চাদর পাতা আছে মনের আঙিনায়।
 
এছাড়াও 'ওশিন' নামের একটি টেলিভিশন সিরিয়াল দেখেছিলাম ৯০'র দশকে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জাপানের গ্রামীণ ও সামাজিক অবস্থাকে মনের মাঝে স্থান দিয়েছিল। একটা নীরব অনুসন্ধান চলছিল মনের অজান্তেই।
 
অনুবাদক আলভী আহমেদকে ধন্যবাদ দিতে চাই খুব সহজ ভাষায় উপন্যাসটিকে বাংলায় রূপান্তরিত করায়। তাঁর লেখা আর কোন অনুবাদ যদিও পড়া হয়নি তারপরও বলছি লেখায় গতি আছে। হয়ত তাঁর অনুবাদের প্রাঞ্জলতাই আমাকে টেনে নিয়ে গেছে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত। তবে কৈশোরে পড়া থ্রিলারগুলির অনুবাদই হৃদয়ে বেশি দাগ কেটে দিয়েছেন শামসুদ্দীন নওয়াব, রকিব হাসানরা। 
 
দুই পর্বে বইটি পড়লাম। ঈদের আগে ও পরে। এই ফাঁকে একটি পেইন্টিংয়ে মনযোগ দেওয়ায় পড়ায় ছেদ পড়েছিল। তখনই লেখক হারুকি মুরাকামিকে জেনে নিলাম ইন্টারনেট থেকে। খুব ইন্টারেষ্টিং মনে হলো তাঁর সাহিত্যাঙ্গন। সময়কে তিনি ধারণ করেছেন খুব গভীরভাবে আর জীবনের অভিজ্ঞতাকে রূপান্তরিত করেছেন শব্দে। খুব চমকপ্রদ এবং আকর্ষক এই উপন্যাসের পটভূমি। কোনদিন, কোনকালেই তাতে মরচে ধরবে না। তরুণ-তরুণীর যে মনঃস্তত্ত্বকে তিনি তুলে এনেছেন তা সর্বযুগের, সর্বকালের এবং সর্বত্রই দেখা যায়। কাজেই এর বাজার থাকবেই।
 
পড়তে গিয়ে দেখলাম ৬০'র দশকের শেষভাগের টোকিও শহর। সেখানে তরু ওয়াতানাবে গল্পটি বর্ণনা করতে শুরু করে। ওর নিজেরই গল্প। উত্তম পুরুষে লেখা। সাবলীল বর্ণনা। শুরু থেকেই ভাবছিলাম ত্রিভুজ একটি প্রেম কাহিনী কিন্তু খানিক বাদেই উদ্ধার করলাম ব্যাপারটি ঠিক ত্রিভুজ নয় বরং টিনএজ কিজুকির নামে একটি ছেলের অপমৃত্যুর পর তার প্রেমিকা নাওকোর প্রেমে ওয়াতানাবের জড়িয়ে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত আমি মানতে পারিনি এটা প্রেম। কিছুটা অবসেশন বা অবচেতন মনের হাহাকার।
 
আমার কাছে আরও মনে হয়েছে এ অনেকটা অল্প বয়েসের আবেগ (ইন্ফ্র্যাচুয়েশন) যে কিনা দুই বন্ধুর মাঝে থেকে অসহায় সামাজিক-পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে একটি আরোপিত দায়িত্বে নিমজ্জিত। অনেক বেকুব কিসিমের ভালো মানুষরা এই পরিস্থিতিতে পড়ে! আবার এক সময় মনে হয়েছে নাওকোর প্রতি সেটা ছিল করুণা, কিজুকির বেঁচে থাকা পর্যন্ত নাওকোর হাত ধরতে বা জড়িয়ে ধরতে না পারার আক্ষেপ। ধীরে ধীরে সবই উদ্ধার হয়েছে। ওয়াতানাবে মাত্র দুই বসন্ত না যেতেই জেনে গেছে 'নরওয়েজিয়ান উড' গানের মর্মার্থ। তবে এই দুই বছরে অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেকে জানতে হয়েছে ভিতর থেকে।
 
জাপানী তরুণ-তরুণীদের জানতে শুরু করলাম প্রতি পাতায়। সামান্য অতীতের সাথে কলেজ পেরিয়ে ওদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। সেই জীবনের দিনপঞ্জি, নিত্যকার ঝক্কি-ঝামেলা। ভালোই লাগছিলো উপন্যাসের পাতায় পাতায় ৬০'র দশকের শেষ অংশের টোকিও শহরকে উদ্ধার করে। একটি একটি করে চরিত্র এসেছে ওয়াতানাবের মাধ্যমে আর আমিও ফিরছিলাম আমার যৌবনের প্রথম প্রহরে। মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি বারকয়েক। কেননা জাতি, বর্ণ, ধর্মের নানান বিবেধ থাকলেও মানুষের মন চিরকাল একই রকম!
 
স্টর্ম ট্রুপার চরিত্রটি আমার খুব পরিচিত। বর্ণনা মতন মিলিয়ে নিলাম আমাদের কৈশোর-যৌবনের মুখগুলি। এই লোক ভালো ম্যাপ রিড করতে পারে, ব্যায়াম করে, পরিছন্ন থাকতে পছন্দ করে, ওয়াতানাবেকে শাসন করে, নিয়মানুবর্তী। ওর সরল জীবন দর্শন অন্যদের আড্ডায় হাসির খোরাক যোগায়। একবার নিজেকেও খুঁজে পেলাম ওর মাঝে কেননা আমার কতিপয় বন্ধু কোন মেয়ের প্রেমে পড়লেই আড্ডাগুলিতে আমাকে বেচে দিতে কুন্ঠা বোধ করতো না! ১৯৯৭ সালে বাংলা নববর্ষে তো উপাধি দিয়েছিল, "প্রেমের ঘাটে মাঝি, কারো কাছে পয়সা নেয় না।"  
 
নাগাসাওয়া চরিত্রটি নিয়ে আমার উচ্ছাসের শেষ নেই। প্রচন্ড বাস্তববাদী, অতুলনীয় মেধাবী, রমন বা রতিক্রিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। প্রজাপতির মতন উড়ে উড়ে সে নারী দেহ আস্বাদনে অভ্যস্ত। এ নিয়ে তার গর্বেরও শেষ নাই! আমার সন্দেহ সত্য প্রমাণ করে ঘটনা প্রবাহ জানান দেয় যে নাগাসাওয়া একটি ভেঙে যাওয়া পরিবারে বেড়ে উঠেছে। তার বাবার জীবনেও একাধিক রমণীর উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সে ওয়াতানাবেকে বাস্তববাদী দুনিয়ায় আসতে উদ্বুদ্ধ করলেও নিজের জীবনের একটি হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়।
 
সাধারণত এরকম আউট স্পোকেন চরিত্রগুলিতে মানসিক ভারসাম্যের বিষয়ে একটু হেরফের থাকে। তাইতো হাটসুমির মতন কাঙ্খিত রমণী জীবনে ধরা দিলেও আকাশের তারা হয়ে মিলিয়ে যায়। হাটসুমির আত্মহত্যা আমাকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। জাপানে কি আত্মহত্যার হার তুলনামূলকভাবে বেশি? মোট তিনটি আত্মহত্যার সাথে মুরাকামি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই উপন্যাসে। নাগাসাওয়ারা অসম্ভব মেধাবী বিধায় প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিকই কিন্তু সমাজে গ্রহণীয় হয়ে উঠে কি? ওয়াতানাবের জীবনে দারুন প্রাণবন্ত ছিল নাগাসাওয়ার উপস্থিতি।
 
মিদোরি নামটিতে আমি মগ্ন হয়েছিলাম শুরু থেকে শেষ অব্দি। ও যে দারুন অভিনয় জানে তা প্রথম থেকেই স্পষ্ট। প্রতিটি কথায় বোঝা যায় প্রেমই ওর জীবনে পরম আরাধ্য বিষয়। মুখে হাতি-ঘোড়া মারলেও প্রচন্ড আদরের কাঙাল, মধ্যবিত্ত, দুঃখী, না পাওয়ার বেদনায় প্রায়ই মুষড়ে পরা একজন মানুষ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এরকম নারী ও পুরুষ উভয়েরই দেখা মিলেছে। নাম বলা যাবে না কেননা তারা এখনো জীবিত।
  
তবে মিদোরির সবচেয়ে ভালো গুণ হলো একাগ্রচিত্তে ওয়াতানাবেকে ধারণ করা। দুর্বল চিত্তের পুরুষ ওয়াতানাবে নিজেকে খুঁজে পেতে নাওকোর মৃত্যু অবধি অপেক্ষা করে। বয়সে বড় কমন বন্ধু রেইকো ইশিডার সাথে রতি মিলন করে তবে মিদোরিতে মনোযোগ দেয়। এই ধরণের মেয়ে জাপানের সমাজে দেখা পাওয়ায় দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়েছি। যৌথ-পরিবারকেন্দ্রিক সমাজ, খাদ্যাভাস, কৃষিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা আমাদের (বাঙালি ও জাপানি) জীবনকে একই সূঁতোয় গেঁথেছে। মিদোরিকে আমারই ভালো লেগে গেছে।  
 
রেইকো ইশিডা একটি মজার সংযোজন। একই সাথে তার অনেকগুলি পর্ব। মিউজিক টিচার, কিঞ্চিৎ বহুগামিতার অপবাদে সমাজ থেকে দূরে, সহনশীল, নাওকোর সহচরী, সেবাদানকারী কিন্তু মনের মাঝে ওয়াতানাবেকে আস্বাদনের অভিলাষ। আমি ভেবেছিলাম মাঝ পথেই না অঘটন ঘটে। তবে তা হয়নি কোন এক অজানা কারণে। হতে পারে জাপানিজ সমাজ ব্যবস্থা কিংবা চক্ষুলজ্জা। তার সঙ্গে জোরপূর্বক সমকামি পর্বের ঘটনাটি ইঙ্গিত দেয় সব সমাজেই এসব আচরণ ছায়ার মতন অনুসৃত হয়।
  
মানুষ সব প্রকাশ করে না লোকলাজে। শেষ অংকে এসে অবশ্য সামান্য হোঁচট খেয়েছি কেননা যখন সুযোগ ছিল তখন রেইকো ছিল পরিশীলিত ব্যক্তিত্বের অধিকারীনি কিন্তু নদী মোহনায় এসে সাগরে না মিশে পারে না তার প্রমাণ বিদায় বেলায় ওয়াতানাবের সাথে ওর দৈহিক সম্পর্ক। ঠিক এই সময় বইটি বন্ধ করে ২০০৩ সালের বাংলা সিনেমা ব্যাচেলরে ব্যবহৃত "মানুষ আমি আমার কেন পাখির মতন মন" গানটি শুনলাম আর হাসলাম!
  
ফাঁকিবাজ পাঠকদের জন্য কয়েকটি লাইন তুলে দিলাম।
 
১. ওয়াতানাবে আর মিদোরির কথোপকথন: "তুমি তোমার  বাবাকে পছন্দ করো? না, তেমন একটা না। তাহলে তুমি তার কাছে কেন যেতে চাও? তাকে পছন্দ করি না, কিন্তু বিশ্বাস করি।"
 
২. হাটসুমির মৃত্যুর পর নাগাসাওয়ার উপলদ্ধি: "ওর মৃত্যুর পর আমার ভেতরে কিছু একটা নিভিয়ে দিয়েছে। আমি খুব কঠিন একটা মানুষ। কখনো আবেগ-অনুভূতির মতো তুচ্ছ ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু ও মরে যাওয়ার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি ঠিক আমি নেই। বিশ্বাস করো ওয়াতানাবে, আমি ঠিকঠাক নেই।"
 
৩. ইতোহ নামের সহকর্মীর (সে আর্ট কলেজের ছাত্র) বয়ান ওয়াতানাবেকে উদ্দেশ্য করে: "পাস করে তোমার প্ল্যান কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ইতোহ বলে, প্ল্যান আর কি, প্ল্যান করে কি আর শিল্প হয়, বলো? আমি পড়াশোনা করেছি অয়েল পেইন্টিংয়ে। এটা এমন একটা জিনিস যেটা কেউ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য করে না। মনের জন্য করে। আর মনের জন্য করতে করতে একসময় তার নাম ফাটতে শুরু করে। নাম ফাটতে কারো কম সময় লাগে কারো হয়তো সারাজীবন কেটে যায়। আসলে সে বিখ্যাত হওয়ার জন্য করে না। মনে আনন্দে করে।
 
৪. মেধাবী নাগাসাওয়ার কাছে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা: "ভদ্রলোক হচ্ছে তারাই, যারা মন যা চায় সেটা করে না। বরং সেটাই করে, যেটা তাদের করা উচিত।"
 
৫. নাওকো-ওয়াতানাবে-মিদোরি ত্রিমুখী সম্পর্কের সমাধান দিতে গিয়ে ওয়াতানাবেকে রেইকো লিখে, "আমার মনে হয় গোটা পৃথিবীকে তুমি খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছ। তোমাকে বুঝতে হবে, পৃথিবী একটা আনন্দের জায়গা। এখানে তুমি যদি সবকিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে চাও তাহলে মজা করে বেঁচে থাকতে পারবে না।"  
  
বিটলসের নরওয়েজিয়ান উড নামটি সার্থক। কেননা গানটি বলে, জীবনে নারী আসবে, পরিস্থিতি হয়তো তোমাকে তখনও লায়েক করে তোলেনি, সে চলে গেলেই জানবে আবার নারীর আগমন ঘটানোর চেষ্টা করতে হবে কেননা 'জীবন এক বহতা নদী' একে বাঁধ দিতে নেই।
  
নরওয়েজিয়ান উড- হারুকি মুরাকামি, 
অনুবাদ- আলভী আহমেদ
প্রচ্ছদ- সব‍্যসাচি মিস্ত্রী 
প্রকাশক- বাতিঘর