গণতন্ত্রের রূপান্তরের আকাঙ্খায় বাংলাদেশ । সোহরাব হাসান

গণতন্ত্রের রূপান্তরের আকাঙ্খায় বাংলাদেশ । সোহরাব হাসান


গত বছর আগস্টে ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নেওয়ার পর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে ১০ মাস সময় পার করেছে। তাদের মধুচন্দ্রিমা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসী তাদের সাফল্য ব্যর্থতার হিসেব নিতে চাইবে।
  
আশা করা গিয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার যত দ্রুত সম্ভব রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের কাজটি সম্পন্ন করবে। বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে সে রকম কিছু লক্ষ করা যায়নি। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের পরিধি কিংবা নির্বাচনের দিনক্ষণ- কোনো বিষয়ে একমত হতে পারছে না। 
 
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, চলতি বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছর জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

 

বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তারা চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করতে আগ্রহী। কেবল জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়া নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এপ্রিলের সময়সূচিকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকারের  জন্য এটা বড় ধাক্কা বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। 
 
অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নেয় তখন দেশে এক নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছিল। জনপ্রশাসন প্রায় অকেজো, পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মহা বিশৃঙ্খল অবস্থা। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও  জননিরাপত্তা নিশ্চিত করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। এরপর ভেঙে পড়া অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার, জুলাই-আগস্টের হত্যাকারীদের বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে। 

 
সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার অনেকগুলো কমিশন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন বিষক কমিশন উল্লেখযোগ্য। জনমনে যেই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো সরকার অনেক বিষয়ে কমিশন করলেও শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারে কোনো কমিশন গঠন করেনি। এটা নিয়ে বেশ সমালোচনা আছে। 

 
সমালোচনা আছে সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও। সংবিধান সংস্কার নিয়ে কমিশন যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সভা বা গণপরিষদ গঠন করতে হবে। কিন্তু বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল সংবিধান সভার বিরুদ্ধেই মত দিয়েছে। তারা বলেছে, যেখানে গত তিনটি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি, সেখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করাই বড় সংস্কার হবে। 
 
বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও জনমনে প্রশ্ন আছে। ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব নেতা জুলাই আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত, যারা দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে কেউ আপত্তি করতেন না। কিন্তু যখন আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিসেবীসহ আওয়ামী লীগের শত শত নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে ঢালাও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, তখন এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। অন্যদিকে যেই বিতর্কিত আইন দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেই আইনেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। 
 
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপরাধের বিচারের পাশাপাশি জাতীয় রিকনসিলেশন বা পুনরেত্রীকরণের কথাও বলা হয়েছিল। ৫৪ বছর ধরে যে বিভক্তির রাজনীতি চলে আসছে, তার অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেদিকে না গিয়ে পুরোনো পথেই হাটছে। 
 
আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করতে বিরোধী দলের লাখ লাখ নেতা–কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিল। এর আগে বিএনপির সরকারের আমলেও আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে হযরানিমূলক মামলা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ‘বিএনপি জামায়াত’ ট্যাগ লাগানো হতো। এখন ‘আওয়ামী দোসর’ নামে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। 
 
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে বলেছিলেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই-উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে, সে জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
 
কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে সেই  ‘এক পরিবার দর্শন’ প্রতিফলিত হয়নি। সরকার নির্বাচন, সংবিধান, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার-ছয়টি বিষয়ে যে কমিশন গঠন করেছিল, তাতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। নারী সদস্যও ছিলেন তুলনামূলক কম। 
 
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা আলোচনায় সরকার বিভক্তি কমাতে পারেনি। এখন দ্বিতীয় দফা আলোচনা চলছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সব সংস্কার করে নির্বাচন করার পক্ষপাতী। কিন্তু বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলোর দাবি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য যেটুকু সংস্কার দরকার, অন্তর্বর্তী সরকার সেটুকু করবে। অন্য সংস্কারগুলো করবে নির্বাচিত সরকার। 
 
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও দ্বিধাবিভক্ত। এক পক্ষ চাইছে ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হোক, আরেক পক্ষ নির্বাচন বিলম্ব করতে চাইছে। ধারনা করা যায়, প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধের কথা বলে দুই পক্ষকে খুশি করতে চাইছেন। 
 
নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যে অনিশ্চয়তা চলছে, তার ছাপ অর্থনীতি ও ব্যবসা–বাণিজ্যেও পড়েছে। মাস কয়েক আগে সরকার মহাসমারোহে বিনিয়োগ সম্মেলন করলেও দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। তারা নির্বাচিত সরকারের অপেক্ষায় আছে। 
 
গত ১০ মাসে সরকারকে বেশি বিব্রত করেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবি ও সেনা সদস্যরাও মোতায়েন আছে। তারপরও অপরাধ কমছে না। থেমে থেমে সংঘবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। প্রশাসন ও পুলিশের ওপরও সরকারের কর্তৃত্বও দুর্বল। যেখানে যে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি, প্রশাসন ও পুলিশ তাদের কথামতো কাজ করে।
 
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, দা কমাতে  না পারলে গণ–অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য যেমন ব্যর্থ হবে, গণতন্ত্রের অভিযাত্রাও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ কারণে জুলাই আন্দোলনের সুহৃদরা বিএনপি ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যকার বিরোধ কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠককেও তারা দেখছেন ইতিবাচক দৃষ্টিতে। 
 
যেদিন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, সেদিন মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন প্যারিসে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবেন। ওই দিন সন্ধ্যায় ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে প্রথম তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের বারবার অনুরোধে তিনি সরকারের দায়িত্ব নিতে রাজি হন।
 
অতএব ১০ মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা বিচার করতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে। অতীতে আমাদের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত সরকারগুলো কী করেছে, তা-ও মনে রাখতে হবে।
 
অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের দুটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করা প্রয়োজন। একটি হলো টিমওয়ার্ক বা সমন্বিত কার্যক্রম। অতীতের প্রায় সব সরকারই ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক—সরকারপ্রধান না বললে কিছু হতো না। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা স্বাধীনভাবেই মন্ত্রণালয় পরিচালনা করছেন। দ্বিতীয়ত, এই সরকারের উপদেষ্টাদের দক্ষতা নিয়ে যত সমালোচনাই থাকুক, এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় এটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। 
 
মুহাম্মদ ইউনূস যাঁদের নিয়ে সরকার গঠন করেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনীতি ও প্রশাসনের বাইরের মানুষ। স্বাভাবিকভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় তাঁদের পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে। বয়স, অভিজ্ঞতার কারণেও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সবার কাজের দক্ষতা একই রকম নয়। কয়েকজন নিজের মন্ত্রণালয় চালানোর বিষয়ে সক্রিয়তা দেখালেও অন্যদের এ বিষয়ে বেশ ঘাটতি আছে।
 
বাংলাদেশে এর আগে যতগুলো রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, তার পেছনে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। পার্থক্য হলো, ৫ আগস্টের পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও তারা বেসামরিক প্রশাসনে নাক গলায়নি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার কোনো ইচ্ছা তাঁদের নেই। বেসামরিক সরকার যে সেনাবাহিনীর অব্যাহত সহযোগিতা পেয়ে আসছে, সেটাও মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া সম্ভব হতো কি না, সন্দেহ আছে। 
 
১০ মাস আগে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার কবে ও কীভাবে প্রতিশ্রুতি পালন করে সেটাই দেখার বিষয়। প্রায় অনভিজ্ঞ সরকারের কাছে জনমানুষের যে আকাঙক্ষা তা পূরণ করতে হলে সরকারকে আরও বেশি দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে নিরপেক্ষ ও ন্যায়ানুগ। 
  
সোহরাব হাসান :  কবি ও সাংবাদিক; যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো
প্রকাশিত বই: বাতিল রাজদণ্ড; কালো বারুদ; সাদা গোলাপ; সুন্দর তোমার সর্বনাশ; শূন্যতার কাছে প্রার্থনা; ভুল করে বেঁচে আছি; নির্বাচিত কবিতা; তৃতীয় বিশ্বের কবিতা (সম্পাদনা)
প্রবন্ধ: মুজিব ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধ; নেই গণতন্ত্রের দেশে;  ১৯৭১ এর শত্রু মিত্র; স্বাধীনতার প্রস্তুতি পর্ব- শেখ মুজিবের আগরতলা মিশন; রাওয়ালপিণ্ডি ষড়যন্ত্র- ১৯৫১; শহীদ মতিউরের নোটখাতা। 
বসবাস : ঢাকা, বাংলাদেশ।